ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৫, ১১:৫৮ পিএম
- দেশের বাজারে অস্থিরতার সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ
বর্তমান সংকটকালে ক্রেতারা দ্রুত পণ্য চায়, যা আমরা দিতে পারি না— মোহাম্মদ হাতেম, সভাপতি, বিকেএমইএ
নানা সংকটে দেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক খাত। যা মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশের বেশি অবদান রাখে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই খাতটি শ্রম অসন্তোষ, ডলার সংকট, ঋণপত্র খোলার হার কমে যাওয়া, ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার এবং গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটসহ নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে।
পোশাকশ্রমিকরা নিয়মিত তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নামছেন। ফলে সংকটের মুখে পড়েছে এ খাত। এই সুযোগে এগিয়ে যাচ্ছে প্রতিযোগী দেশগুলো।
জানা যায়, বাংলাদেশের পোশাক খাত যখন বৈশ্বিক বাজারে বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে এবং প্রতিবেশী দেশ ভারত এই সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে। ভারত পোশাক রপ্তানিকারকদের আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা করেছে, যা সস্তা শ্রম এবং শক্তিশালী টেক্সটাইল উৎপাদন ব্যবস্থা সুবিধা দিচ্ছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের ক্রয়াদেশ ভারতে চলে যাচ্ছে, যা বাংলাদেশের বাজার শেয়ারে ব্যাপক ক্ষতি করতে পারে।
বাংলাদেশ রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের প্রধান বাজারগুলোতে রপ্তানি কমছে, কারণ খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো বিকল্প গন্তব্য খুঁজছে। অন্যদিকে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ভারতের পোশাক রপ্তানি বেড়েছে। জানা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে দশমিক ৪৬ শতাংশ কমে ৬৭০ কোটি ডলারে নেমেছে। যেখানে ভারতের রপ্তানি ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ বেড়ে ৪৪০ বিলিয়ন ডলারে উঠেছে। বহুদিন ধরে পোশাক খাতে আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে আসা ভারত সরকার এটাকে বড় সুযোগ ধরে তা কাজে লাগাতে আগ্রহী। ভারতে টেক্সটাইল বা বস্ত্র খাতের উন্নয়নে সরকারি অর্থায়নে বহু প্রকল্প চলমান আছে। পাশাপাশি রপ্তানিকারকদের জন্য প্রণোদনা ও শুল্ক ছাড়ের সুবিধাও রাখা হয়েছে।
এদিকে, প্রায় সব খাতেই রপ্তানি ভর্তুকি কমিয়েছে বাংলাদেশ। এর দুটি কারণ দেখিয়েছে সরকার। যার মধ্যে রয়েছে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ওপর চাপ কমানো এবং ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) মর্যাদা হারানোর পর বাংলাদেশের রপ্তানিকারকদের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য প্রস্তুত করা। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা বাড়াতে রপ্তানিকারকরা যে নগদ সহায়তা পেত তাও কমানো হয়েছে। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এটি সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়। আর চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই সুবিধা আরও কমিয়ে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়াও উৎপাদন ব্যয়ের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেও রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সুবিধাও কমানো হয়েছে।
এদিকে, চীনের পর বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক বাংলাদেশ। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) তথ্য অনুযায়ী, বছরে ৩৮ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে তৈরি পোশাকের বাজারের ৭.৪ শতাংশ দখল রেখেছে বাংলাদেশ। বিপরীতে, ভারত পঞ্চম বৃহত্তম অবস্থানে থেকে বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে ৩ শতাংশের বেশি দখলে রেখেছে।
এদিকে, বাংলাদেশের অর্ডার ভারতে চলে যাওয়ার প্রধান কারণ রাজনৈতিক সংকট হলেও এক্ষেত্রে চীনা পণ্যের ওপর যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প প্রশাসনের উচ্চ শুল্ক আরোপের সম্ভাবনা ভূমিকা রাখতে পারে। আন্তর্জাতিক খুচরা বিক্রেতা ও ব্র্যান্ডগুলো ঝুঁকি নিতে চায় না। সেই কারণে দুই বছর আগেও ভারত, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও ইথিওপিয়া থেকে বিপুল রপ্তানি আদেশ বাংলাদেশে এসেছিল। কারণ তখন ভালো দাম, গুণমান ও অনুকূল ব্যবসার পরিবেশ ছিল। একইভাবে এখন বাংলাদেশের অর্ডার চলে যাচ্ছে, ভারতও তা লুফে নিচ্ছে।
শুধু আর্থিক সহায়তা দিয়েই শেষ করেনি ভারত, বিশ্ববাজারে দখল বাড়াতে আগ্রাসী অভিযানে নেমেছে। ফেব্রুয়ারিতে দিল্লিতে বড় বস্ত্রমেলার আয়োজন করছে ভারত। ‘ভারত টেক্স ২০২৫’ নামে এই মেলা হবে সবচেয়ে বড় টেক্সটাইল প্রদর্শনী। সেখানে বিশ্বের নামিদামি ব্র্যান্ড ও ক্রেতাদের টানার চেষ্টা করবে ভারত।
তৈরি পোশাকশিল্পের মালিক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ এবং বিটিএমএর তথ্য বলছে, দেশে গত জুলাই ও আগস্ট- এই দুই মাসের ছাত্র-জনতার আন্দোলন, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদল এবং চলমান অস্থিরতার কারণে কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। সময়মতো ‘শিপমেন্ট’ করা যায়নি। ফলে সময়মতো মাল দিতে উড়োজাহাজে পণ্য পাঠাতে হয়েছে। এতে বাড়তি খরচ পড়েছে। তা সত্ত্বেও ৪৫ শতাংশ কারখানার রপ্তানির এ সময় বাতিল হয়েছে। এতে সামগ্রিকভাবে পোশাক ও বস্ত্র খাতে দুই বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি ক্ষতি হয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে অনেক কারখানায় বেতন দিতে দেরি হচ্ছে। শ্রমিকদের মধ্যে বেতন-বোনাস নিয়ে অসন্তোষ দীর্ঘদিনের। শ্রমিকরা বলছেন, বাজারদরের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মজুরি নির্ধারণ হোক।
কারখানা শ্রমিকদের ন্যূনতম বেতন ২৩ হাজার টাকা করার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকরা আন্দোলন করে আসছেন।
গার্মেন্ট শিল্প-মালিকদের সংগঠন বিজেএমইএর সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান জানান, বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বেগবান করতে পোশাকশিল্পের কোনো বিকল্প নেই। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিদেশ থেকে যে রেমিট্যান্স আসছে তার অন্যতম খাত হলো গার্মেন্টশিল্প। প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিকের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ প্রচুর বৈদেশিক অর্থ আয় করছে। যে কোনো দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতি নিঃসন্দেহে সে দেশের শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। সময়ের প্রয়োজনে অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তনশীল। ভোক্তা চাহিদা অনুযায়ী পণ্যের বহুমুখীকরণ বা বৈচিত্র্যসাধন, কারখানায় আধুনিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার ও দক্ষ জনবল তৈরির মাধ্যমে নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব হলে পোশাকশিল্প দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে। এদিকে, পোশাক খাতের সংকটের প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগের ওপর।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর) মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা হয়েছে ৫৮ কোটি মার্কিন ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ে ছিল প্রায় ৮৭ কোটি ডলার, এক বছরের ব্যবধানে ঋণপত্র খোলা কমেছে ৩৩ শতাংশ। ঋণপত্র নিষ্পত্তির হারও ১৯ শতাংশ কমেছে। মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ার মানে হলো বিনিয়োগ কমে যাওয়া এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টি ব্যাহত হওয়া, যা অর্থনীতিতে দীর্ঘকালীন নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এমন সংকটে তৈরি পোশাকের বাজারে দেশের দখল ধরে রাখা ও প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য উদ্যোক্তাদের উদ্ভাবনী কৌশল যেমন জরুরি, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহায়তা খুবই জরুরি। এখন নজিরবিহীন এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি পার করছে বাংলাদেশ। এই রাজনৈতিক অস্থিরতা কমাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা অপরহাির্য।
ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, এদিকে নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, বর্তমান সংকটকালে ক্রেতারা দ্রুত পণ্য চায়, যা আমরা দিতে পারি না। আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ কারণে অনেক অর্ডার বাতিল করতে হচ্ছে। পণ্য পাঠাতে বিলম্বের জন্য তিনি দেশে গভীর সমুদ্র বন্দরের অভাব, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামো সমস্যার পাশাপাশি কাস্টমসের হয়রানিকে দায়ী করেন।
তিনি বলেন, এক বছরের মধ্যে নিট পোশাক খাতে ৫০টির বেশি কারখানা বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ হাজারের বেশি শ্রমিক বেকার হয়েছে। যারা চাকরি হারাচ্ছে, তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াচ্ছে। তিনি বলেন, তৈরি পোশাক খাতের পরিস্থিতি এই পর্যায়ে আসার পেছনে শ্রম অসন্তোষ অন্যতম।