নিজস্ব প্রতিবেদক
ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৫, ১২:০৮ এএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
ফেব্রুয়ারি ৩, ২০২৫, ১২:০৮ এএম
বাংলাদেশের মিঠাপানিতে দেশি জাতের মাছের সংকট ও সমুদ্রসীমায় মাছের মজুত হ্রাস পাওয়ায় শুঁটকি উৎপাদনেও প্রভাব পড়ছে।
এদিকে, প্রতিবছর শুঁটকি খাত থেকে বাংলাদেশের রাজস্ব আয় হয় কোটি কোটি টাকা। এছাড়া জাপান, যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, এবং অন্যান্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশে মাছ রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা হয়; শুঁটকি উৎপাদন কমে যাওয়ার প্রভাব পড়ছে রপ্তানি খাতেও।
সূত্রমতে, প্রতিবছর শুঁটকি খাত থেকে বাংলাদেশের রাজস্ব আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে প্রায় ২০ হাজার টন শুঁটকি রপ্তানি করা হয়। সংশ্লিষ্টরা মাছ উৎপাদনে ঘাটতির কারণ হিসেবে অতিরিক্ত মাছ ধরা, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং নদ-নদীর দূষণকে চিহ্নিত করেছেন।
বাংলাদেশের একটি বৃহৎ শুঁটকি উৎপাদনের ক্ষেত্র হলো, সুন্দরবনের দুবলার শুঁটকিপল্লিতে। কিন্তু মাছের ভরা মৌসুমও সেখানে মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। সাগরে জাল ফেলে প্রত্যাশা অনুযায়ী মাছ পাচ্ছেন না জেলেরা। মাছ শুকানোর বেশিরভাগ ভারা (মাচা) ও চাতাল খালি পড়ে আছে। শুঁটকি উৎপাদন কম হওয়ায় এ বছর রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হতে পারে বলে মনে করছে বন বিভাগ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
বন কর্মকর্তারা জানান, ধীরে ধীরে সাগরের গভীরতা কমছে। পরিবর্তিত হচ্ছে পানির গতিপথ। যে কারণে মাছের আধিক্য কম হতে পারে। অন্যদিকে সাগরে ঘন ঘন সৃষ্টি হচ্ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ফলে সাগর উত্তাল থাকায় ঠিকমতো জাল ফেলতে পারছেন না জেলেরা। মাছ কম হওয়ার এটিও একটি কারণ। মাছ সংকটের কারণে শুঁটকি উৎপাদন না হওয়ায় সপ্তাহে এক থেকে সোয়া কোটি টাকা রাজস্ব ঘাটতির আশঙ্কা রয়েছে।
সুন্দরবন পূর্ব বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কাজী মুহাম্মদ নুরুল করীম বলেন, মাছ না পাওয়ায় জেলে-মহাজনদের লোকসানের পাশাপাশি সরকারি রাজস্ব আয়েও ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। গত বছর শুঁটকি খাত থেকে রাজস্ব আয় হয়েছিল সাত কোটি ২৩ লাখ টাকা। এবার আট কোটি টাকা লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা কম। এদিকে, সিরাজগঞ্জের তাড়াশে হুমকির মুখে মিঠা পানির মাছের চলনবিলের শুঁটকি শিল্প। চলতি মৌসুমে অন্যান্য বছরের তুলনায় কমেছে উৎপাদন। বর্তমানে চলনবিলের দেশীয় মাছের শুঁটকির দাম আকাশ ছোঁয়া। এ পরিস্থিতিতে অবৈধ জালের বহুল ব্যবহার এবং নিষেধাজ্ঞার সময়ে ডিমসহ মা মাছ শিকারের ফলে বিল অঞ্চলে মাছের উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয়রা।
এদিকে রাক্ষুসে মাছ বেড়ে যাওয়ায় বিলে দেশীয় মাছের পরিমাণ কমেছে বলে জানায় উপজেলা মৎস্য অফিস।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা গেছে, আশ্বিন থেকে মাঘ মাসকে বলা হয় দেশীয় মাছের শুঁটকি তৈরির মৌসুম। এ বছর উপজেলায় দেশীয় মাছের শুঁটকি উৎপাদন হয়েছে ২২০ টন, যা গত বছর ছিল ৩০৭ টন। তা ছাড়া এ বছর খাল-বিলে রাক্ষুসে বোয়াল মাছের সংখ্যা বেশি হওয়ায় ছোটজাতের দেশীয় প্রজাতির মাছের সংকট দেখা দিয়েছে। চলনবিলকে বলা হয় মাছের উন্মুক্ত প্রজননক্ষেত্র। বর্ষায় বিলে পানি ঢোকা শুরু হলে নতুন পানিতে ডিম ছাড়তে ঝাঁকে ঝাঁকে মা মাছ আসে। ঠিক এ সময়টিতেই ডিমসহ মা ও পোনা মাছ ধরতে চায়না দুয়ারি জাল, সুতি জালসহ নানা অবৈধ জাল পেতে রাখেন অসাধু জেলেরা। এসব জালে আটকা পড়ে মারা যাচ্ছে অসংখ্য রেণুপোনাও। এতে আশঙ্কাজনকভাবে কমেছে দেশীয় মাছের উৎপাদন হার। চলনবিল অঞ্চলে এ বছর নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত বাউত উৎসব বা পোলো উৎসবেও সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, পাবনার চাটমোহর ও নাটোরের সিংড়ায় মেলেনি মাছ। ফলে পণ্ড হয়েছে উৎসব। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে দলবেঁধে এ উৎসবে যোগ দেয়া মানুষগুলো ফিরে গেছে খালি হাতে। বিষয়টিকে বিল অঞ্চলের জেলেদের জন্য অশনি সংকেত হিসেবে দেখছেন স্থানীয় সচেতন মানুষ।
এদিকে শুঁটকির চাতাল মালিকদের ভাষ্য, চলনবিলে উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে দেশীয় মাছের পরিমাণ। পাঁচ বছর আগেও ৮-১০ লাখ টাকায় স্বাচ্ছন্দ্যে মৌসুমি শুঁটকি ব্যবসা পরিচালনা করা সম্ভব ছিল। তখন মাছের দাম যেমন কম ছিল, তেমনি জোগানও ছিল পর্যাপ্ত। বর্তমানে এ ব্যবসায় পুঁজি বাড়াতে হয়েছে প্রায় তিনগুণ। পাশাপাশি মাছের অস্বাভাবিক দাম বাড়ায় ও চাহিদামাফিক মাছের সরবরাহ না থাকায় এ ব্যবসা লাটে ওঠার উপক্রম হয়েছে।
অন্যদিকে, মৎস্য ভাণ্ডার হিসেবে খ্যাত উত্তরের জেলা নওগাঁর আত্রাই উপজেলা। এ উপজেলায় প্রায় শতাধিক জলাশয় রয়েছে। এখানে উৎপাদিত দেশি বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ পুঁটি, টাকি, শৈল, চান্দা ও চোপড়ার শুঁটকির কদর রয়েছে দেশজুড়ে। এ বছর বন্যা কম হওয়ায় নদী ও জলাশয়গুলোতে দেশীয় মাছ কমেছে। এতে প্রতিকেজিতে ৪০-৫০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে দেশীয় মাছ পুঁটি, খলিশা ও টাকি। এতে দেশীয় মাছ সংকটে শুঁটকি উৎপাদন কমেছে। এর সঙ্গে জড়িতরাও কষ্টের মধ্যে পড়েছে।
আত্রাই উপজেলার ভরতেঁতুলিয়া শুঁটকি পল্লিতে গত এক মাস থেকে শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন এর সাথে জড়িতরা। শুঁটকি বিক্রি করে সারা বছর চলে ভরণপোষণ। তবে এ বছর মাছ সংকটে শুঁটকি উৎপাদন নিয়েও দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা। অনেক চাতাল এখনো ফাঁকা পড়ে রয়েছে। এ সব শুঁটকি দেশের উত্তরের জেলা সৈয়দপুর, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, জামালপুর ও ঢাকায় সরবরাহ হয়ে থাকে। শুধু দেশেই নয়, ভারতের অঙ্গরাজ্য ত্রিপুরা রয়েছে শুঁটকির কদর। এই মাছগুলো প্রথমে সৈয়দপুর যায়। এরপর সেখান থেকে ট্রেনযোগে ভারতে রপ্তানি করা হয়। ব্যবসায়ীরা জানান, এ বছর বন্যা কম হওয়ায় দেশীর মাছের প্রজনন কমেছে।
শুঁটকি ব্যবসায়ীদের মতে, নদীতে পানি থাকলেও বিল বা অন্যান্য যেসব জলাশয় রয়েছে সেখানে পানি নাই। এতে করে দেশীয় মাছ কম হচ্ছে। আবার চায়না জাল (রিং জাল) দিয়ে মাছ শিকারের কারণে প্রজনন কমেছে। এতে করে প্রতি বছরই কমছে দেশীয় মাছ। কাঁচা মাছ কম থাকায় শুঁটকির চাতাল ফাঁকা পড়ে রয়েছে। মাছের প্রজনন বিষয়ে মৎস্য অফিসের সঠিক তদারকির প্রয়োজন।