নিজস্ব প্রতিবেদক
ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫, ১১:৫৮ পিএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৫, ১১:৫৮ পিএম
৫ আগস্ট ২০২৪। শেষ হয় ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ নির্যাতন-নিষ্পেষণের বিচিত্র অধ্যায়। এদিন শেখ হাসিনা ভারতে পালানোর সাথে সাথে দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিরও অবনতি হয়। দীর্ঘদিন হাসিনা সরকারের রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহূত হওয়া পুলিশ বাহিনীর ওপর শুরু হয় সরাসরি আক্রমণ। পুড়িয়ে দেওয়া হয় বহু থানা, পুলিশ বক্সসহ পুলিশের নানা স্থাপনা। এতে একদিকে যেমন পুলিশের মনোবল ভেঙে পড়ে, তেমনি অপরদিকে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কার্যত অকার্যকর হয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী।
সরকার প্রথম ধাপে মাইনুল হাসানকে ডিএমপি কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান অগ্রগতি না আসায় আসে বড় পরিবর্তন। পরবর্তীতে বাংলাদেশ পুলিশের চৌকস কর্মকর্তা শেখ মো. সাজ্জাত আলীকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ৩৮তম কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে পুলিশ। রাস্তায় শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি পুলিশের সদস্যরাও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় যোগ দেয়। থানাগুলোতে মামলা গ্রহণ ও তদন্ত শুরু হয়। এরপর পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পাশাপাশি শুরু হয় পুলিশের ভেতর-বাইরের নানা পরিবর্তন।
ডিএমপির এই চৌকস কর্মকর্তা ১৯৮৬ সালের ২১ জানুয়ারি সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে তিনি ঝিনাইদহ, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ও এসবিতে দায়িত্ব পালন করেন। উপ-পুলিশ কমিশনার হিসেবে তিনি ডিএমপি, পুলিশ সুপার হিসেবে নড়াইল, বাগেরহাট ও লক্ষ্মীপুর জেলায় দায়িত্ব পালন করেন। তিনি খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
ডিআইজি পদে পদোন্নতি লাভ করে তিনি হাইওয়ে পুলিশ, চট্টগ্রাম রেঞ্জ ডিআইজি, পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স ও ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজির দায়িত্ব সফলতার সাথে পালন করেন। ২০১৬ সালের ৩ নভেম্বর তাকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানের সময় তিনি পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে অতিরিক্ত আইজিপি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। তিনি বর্তমান সরকার গঠিত পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণ করেন এবং দেশে-বিদেশে পেশাগত নানা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
সৎ, দক্ষ, মেধাবী ও কর্মঠ পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে বাহিনীতে সুনাম অর্জনকারী শেখ মো. সাজ্জাত আলী ১৯৬১ সালের ২৫ মার্চ ঝিনাইদহ জেলায় সম্ভান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেখ ওয়েজেদ আলী এবং মাতার নাম নুরজাহান বেগম। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিবাহিত এবং দুই কন্যা ও এক পুত্র সন্তানের জনক। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তিনি চাকরি হারান। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকার ১৭ নভেম্বর জারিকৃত এক প্রজ্ঞাপনের তাকে ২০১৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ভূতাপেক্ষভাবে চাকরিতে পুনর্বহাল করেন। এর আগে তিনি পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন। দক্ষ এই পুলিশ কর্মকর্তার ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ (আইজিপি) হওয়ার কথা থাকলেও ঢাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণসহ নানা দিক বিবেচনা করে ডিএমপি কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। পুলিশের ভাবমূর্তি ফিরিয়ে আনতে নিয়েছেন বেশকিছু উদ্যোগ। তার উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে- জিডির ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক তদন্ত, মামলাযোগ্য অভিযোগ নথিভুক্ত করা, চাঁদাবাজি বন্ধসহ আরও অনেক কিছু। এসব উদ্যোগের মধ্যে আরও রয়েছে-
থানায় জিডিতে এক ঘণ্টায় তদন্ত
থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হওয়ার এক ঘণ্টার মধ্যে পুলিশ সেবা দেবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী। তিনি বলেছেন, আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে এ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জিডিতে তাৎক্ষণিক তদন্তের এই সিদ্ধান্ত ইতিমধ্যে ইতিবাচকভাবে নিয়েছেন সাধারণ মানুষ।
চাঁদাবাজি বন্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি
চাঁদাবাজি বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছেন ডিএমপির এই কমিশনার। এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি চাঁদাবাজদের রুখতে স্থানীয়পর্যায়ে কমিটি গঠন এবং প্রতিটি থানার অফিসার ইনচার্জদের নিবিড় সম্পৃক্ততা চেয়েছেন। তিনি বলেছেন চাঁদাবাজদের প্রতিহত করতে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের পাশাপাশি এই কমিটিতে পুলিশের সদস্যরাও থাকবে। একইসাথে ওসিরা যদি এই কমিটিকে সহযোগিতা না করলে তাহলে সেই ওসি ‘নাই হয়ে যাবে না।’ এছাড়া রাস্তায় হকারদের থেকে ১০০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদার বিষয়েও কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। একইসাথে পুলিশের কেউ চাঁদাবাজির সাথে জড়িত হলে তাকে জবাই করা হবে বলেও মন্তব্য করেন কমিশনার।
অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে লাইসেন্সিং সিস্টেম
ঢাকা শহরের ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগ নিয়েছেন কমিশনার। তিনি বলেছেন, একটি শহর প্লানিংয়ে ২৫ শতাংশ জায়গা রাস্তার জন্য থাকা উচিত। কিন্তু ঢাকায় মাত্র ৭ শতাংশ আছে। ধানমন্ডি, গুলশানসহ কয়েকটি জায়গা ছাড়া বাকি এলাকাগুলোতে প্লানিং করে রাস্তা বানানো হয়নি। অ্যাম্বুলেন্স এবং ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ঢোকে না।
তিনি বলেন, অটোরিকশা ভয়ংকরভাবে বাড়ছে। এটা পরিকল্পিত এবং নিয়ন্ত্রিত পদ্ধতিতে আনতে না পারলে একসময় সকালে উঠে দেখবেন অটোরিকশার যানজটে বসে আছেন। সুতরাং আমরা সরকারের সাথে আলোচনা করে এবং আমাদের সক্ষমতা যাচাই করে শহরে কতগুলো অটোরিকশা চলতে পারবে সেটা নির্ধারণ করব। একইসাথে এগুলোকে ট্যাক্সের আওতায় আনতে হবে।
মামলা নেওয়ার ক্ষেত্রে বন্ধ হচ্ছে হয়রানি
মামলাযোগ্য কোনো ঘটনা ঘটার পরেও থানার ওসিরা যদি মামলা নথিভুক্ত না করে তাহলে সেই ওসিকে এক মিনিটের মধ্যে সাসপেন্ড করা হবে জানান তিনি। সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে ডিএমপি কমিশনারের এই নির্দেশনার পর থেকে মামলাযোগ্য প্রতিটি ঘটনাতেই সাধারণ মানুষ মামলা নথিভুক্ত করতে পারছেন।
গণহারে গ্রেফতারে কমিশনারের ‘না’
জুলাই-আগস্ট-পরবর্তী সময় বিভিন্ন মামলায় নিরপরাধ মানুষকে আসামি করা হয়েছে এবং মামলা থেকে বাদ দিতে চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। এ বিষয়ে গণহারে গ্রেফতার করতে না করেছেন ডিএমপি কমিশনার। গণগ্রেফতারের বিষয়ে তিনি বলেন, জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে যেসব মামলা হয়েছে, তার বেশিরভাগই হয়েছে আদালতের নির্দেশে। এসব মামলার আসামির সংখ্যা ছিল ২০০-এর বেশি। এখন দেখা যাচ্ছে, সবাই ঘটনায় জড়িত ছিল না। গুটি কয়েক লোক জড়িত ছিল। এখন বাস্তবে যেটা ঘটছে, মামলার বাদী সব আসামির কাছে গিয়ে গিয়ে টাকা চাইছে। এ আসামিদের ভয়ের কোনো কারণ নেই, তাদের আমরা গ্রেপ্তার করব না। তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে জড়িত থাকার প্রমাণ মিলবে, আমরা শুধু তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। এই ২০০ আসামিকে গ্রেপ্তারের কোনো সুযোগ নেই।
সব ইউনিটের অভিন্ন পোশাক
পুলিশের ইউনিট ভেদে পোশাক আলাদাকরণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। তিনি বলেছেন, আগের মতো ইউনিটগুলোর পোশাকে আর বৈচিত্র্য থাকবে না। এই সিদ্ধান্তের পর পুলিশের সব ইউনিট একই পোশাক পরবে। এই পদক্ষেপ বাহিনীর অভিযানগুলোকে সুসংহত করবে। ডিএমপি কমিশনার বলেন, বাংলাদেশ পুলিশে দুই লাখ সদস্য আছেন। ১৯ হাজার সিভিল স্টাফ আছেন। বিভিন্ন ইউনিটে আগে পোশাকের ভিন্নতা ছিল। এটি কার্যকর হওয়ার পর ইউনিটগুলোর জন্য পোশাকে আর কোনো ভিন্নতা থাকবে না। সবাই একই পোশাক পরবেন।
সেবাগ্রহীতাদের সাথে সুন্দর আচরণের নির্দেশ
সাধারণ মানুষকে হয়রানিমুক্ত সেবা প্রদানের নির্দেশ দিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। তিনি বলেছেন, অতীতের কিছু উচ্চাভিলাষী পুলিশ কর্মকর্তার কারণে পুলিশের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। আপনাদের কারো বিরুদ্ধে যেন কোনো অভিযোগ আমার কাছে না আসে, সেভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। কারো বিরুদ্ধে আমি ব্যবস্থা নিতে চাই না। কিন্তু কোনো অভিযোগ আসলে ছাড় দেওয়া হবে না। সুন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা দিয়ে জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে। তিনি বলেছেন, একজন ব্যক্তিও যেন সেবাবঞ্চিত না হন, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
ফুটপাতে শৃঙ্খলা আনতে উদ্যোগ
ফুটপাতে শৃঙ্খলা আনতে উদ্যোগ নিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। সব হকারকে একবারে উচ্ছেদ করা অমানবিক বলে মন্তব্য করেন তিনি। কমিশনার বলেন, হকাররা যেন রাস্তা ব্যবহারে সংযত থাকে এবং তাদের কাছ থেকে চাঁদা নেওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ফুটপাত ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা আনতে ডিএমপি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিয়েছে। যানজটের মধ্যে অতিরিক্ত হর্ন বাজানো বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন ডিএমপি কমিশনার। তিনি বলেন, যানজটের মধ্যে হর্ন বাজানো কোনো সমাধান নয়। যারা বারংবার হর্ন বাজায়, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এছাড়া নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ যদি কোনো কর্মসূচির উদ্যোগ নেয়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে স্পষ্ট করেছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার। তিনি বলেছেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের অনেক নেতাকে আমরা ইতোমধ্যে গ্রেফতার করেছি। তারা কারাগারে বন্দি আছেন। তারা যদি কোনো কর্মসূচির উদ্যোগ নেয়, অবশ্যই আমরা ব্যবস্থা নেব। তবে আপাতদৃষ্টিতে আমি কোনো আশঙ্কা দেখি না।