Amar Sangbad
ঢাকা রবিবার, ০৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫,

হুমকির মুখে সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তা

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফেব্রুয়ারি ৯, ২০২৫, ১২:০৯ এএম


হুমকির মুখে সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তা
  • বোরো উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা

  • কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে ১৪ শতাংশেরও বেশি

দেশে কৃষিঋণ বিতরণ কমায় এবার বোরো উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এমনিতেই আমনের উৎপাদন দুটি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বোরোয় ওই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার লক্ষ্যে কৃষি খাতে সহজ শর্তে সুলভ ঋণের প্রবাহ বাড়ানোর ওপর বেশি জোর দেয়া হচ্ছিল। কিন্তু বোরো মৌসুমের আগে দেশের কৃষি খাতে ঋণের প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। 

চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) দেশের কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ ১৪ শতাংশেরও বেশি কমেছে। যার নেতিবাচক প্রভাব বোরো উৎপাদনে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। কৃষি অর্থনীতিবিদ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকগুলো ১৩ হাজার ৮১ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করতে পেরেছে। অথচ গত অর্থবছরের একই সময়ে কৃষি খাতে মোট ঋণ বিতরণের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ২৮০ কোটি ১২ লাখ টাকা। ফলে অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ১৪ দশমিক ৩৯ শতাংশ কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমেছে। সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছরে দেশের কৃষি খাতে মোট ৩৮ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। আর কৃষিঋণ বিতরণ কমলেও অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে কৃষি খাত থেকে ঋণ আদায় বেড়েছে। এর সঙ্গে সঙ্গে কৃষি খাতেই সর্বনিম্ন খেলাপির হার।

সূত্র জানায়, গত ২০২৪ সালের শেষার্ধে পরপর দুটি বন্যায় দেশের কৃষি খাত ব্যাপক মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে শীত মৌসুমের আগেই কোনো কোনো সবজির দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। আর আমনের বীজতলা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় চাষাবাদে বিলম্ব হয়েছে। আবার কোথায়ও পানি জমে থাকায় আবাদ ব্যাহত হয়েছে। তাতে আমনের সার্বিক উৎপাদনেও প্রভাব পড়ে। পাশাপাশি উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রভাবে কৃষির উপকরণ ও উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে। ফলে আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেড়েছে কৃষকের ঋণের প্রয়োজনীয়তা। 

এর মধ্যেই শুরু হতে যাচ্ছে বোরো মৌসুম। কৃষকরা এখন ধানের বীজতলা তৈরি করছে। আর এ মুহূর্তে কৃষিতে ঋণের বিতরণ না বেড়ে উল্টো কমেছে। এ অবস্থায় বোরো মৌসুমে ধানের উৎপাদন কমলে দেশের সার্বিক খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সূত্র আরও জানায়, গত বছর দুটি বন্যা এবং খরাসহ নানা উপদ্রবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কৃষি খাত। ফলে এবার বন্যা-উত্তর কৃষি উৎপাদন বাড়াতে আরও বেশি করে ঋণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু ব্যাংকগুলো কৃষিঋণের প্রতি আন্তরিক না থাকায় ঋণের প্রবাহ কমেছে। এমনিতেই দেশে আমনের উৎপাদন কম হয়েছে। আর আগামীতে বোরোর উৎপাদনও ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কোনোভাবে দেশে বোরো উৎপাদন কম হলে চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না। তাতে আরও বেড়ে যেতে পারে মূল্যস্ফীতি।

এদিকে কৃষি বিশেষজ্ঞ এবং কৃষি অর্থনীতিবিদদের মতে, আগে থেকেই সবজি চাষ, পশুপালন ও মৎস্য চাষের মতো লাভজনক উপখাতগুলোয় মন্দা ভাব ছিল। পরিস্থিতি উত্তরণে কৃষকের ঋণের প্রয়োজন হলেও ঋণ নিতে ব্যাংককে জামানত দিতে হয়। যে কারণে কৃষকরা এখন ঋণের জন্য এনজিও প্রতিষ্ঠান ও অনেক অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের ওপর বেশি নির্ভর করছে। গত পাঁচ মাসে ঋণের জন্য কৃষকদের এনজিওগুলোর ওপর নির্ভরতা বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে গ্রামীণ ব্যাংক এবং বড় ১০টি এনজিও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কৃষি খাতে ১৭ হাজার ৭৪৬ কোটি ১৩ লাখ টাকার ক্ষুদ্র ঋণ দেয়া হয়েছে, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেশি। এনজিওগুলো ঋণ বিতরণের প্রভাব ঠিক রাখতে পারলেও দেশের তফসিলি ব্যাংকগুলো পিছিয়ে পড়েছে। তবে বন্যায় অনেক এলাকায় চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ায় কৃষিঋণের চাহিদাও কমে থাকতে পারে। আর ঋণ প্রবাহ কমায় অবশ্যই উৎপাদনে প্রভাব পড়বে। কৃষক টাকা না পেলে জমিতে সার দিতে পারবে না। আবার ব্যাংকের নানা শর্তের কারণেও প্রান্তিক কৃষকরা ঋণের প্রতি আগ্রহী হন না। 

অন্যদিকে ব্যাংকারদের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণেই কমেছে ব্যাংক খাত থেকে কৃষিতে ঋণ বিতরণ। যদিও দেশের ব্যাংক ও আর্থিক খাতে ঋণ পরিশোধে বরাবরই কৃষি খাত থেকে সেরা পারফরম্যান্স আসে। তবুও এ খাতে ঋণ বিতরণ কমছে। প্রতি বছরই  খাতভিত্তিক ঋণ বিতরণের অনুপাতে আদায়ের হারের দিক থেকে শীর্ষে থাকে কৃষির অবস্থান। এবার কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ কমলেও ঋণ আদায় আগের বছরের তুলনায় প্রায় সাড়ে ১১ শতাংশ বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর পর্যন্ত কৃষিতে ১৬ হাজার ৬৯ কোটি ৫০ লাখ টাকার ঋণ আদায় হয়েছে। আর আগের অর্থবছরের একই সময়ে ঋণ আদায় হয়েছিল ১৪ হাজার ৪১৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের তুলনায় এবার মোট কৃষিঋণ বিতরণে শস্য খাতের অবদান গত অর্থবছরের ৪৫ শতাংশ থেকে কিছুটা বেড়ে ৪৭ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। আর দারিদ্র্য দূরীকরণে ঋণ বিতরণের অংশ ৬ শতাংশ নেমে এসেছে ৪ শতাংশে। গত বছরের তুলনায় মৎস্য খাতে ১ শতাংশ বাড়লেও পশুপালন ও পোলট্রি খাতের বিতরণ ১ শতাংশ বেড়েছে।

এ বিষয়ে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম জানান, সময়মতো কৃষিঋণ পেলে নানাভাবে কৃষক সেটা ব্যবহার করতে পারেন। কিন্তু ঋণ প্রাপ্তিতে জটিলতা আছে। আবার যে ঋণ দেয়া হয়, সেটিও পর্যাপ্ত নয়। ব্যাংকের নানা শর্তের কারণে প্রান্তিক কৃষক আগ্রহী হন না। তবে ব্যবস্থাপনা সহজ হলে এটা আরো বাড়বে।

এ বিষয়ে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, জুলাই-আগস্টে সার্বিক ঋণ প্রবাহ কমে এসেছিল। আবার ১০-১২টি ব্যাংক কিছুটা সমস্যায় পড়েছিল। তারাও তখন ঋণ দিতে পারেনি। তাই সার্বিক কৃষিঋণ বিতরণে এর প্রভাব পড়েছে। কিন্তু কৃষিঋণের টার্গেট দেয়া থাকায় তা ব্যাংকগুলোকে বিতরণ করতেই হবে। আশা করা যায় অর্থবছরের বাকি সময়ে কৃষিতে ঋণ বিতরণ বাড়বে।

সার্বিক বিষয়ে কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান জানান, বন্যা-পরবর্তী সময়ে নানাভাবে কৃষকদের প্রণোদনা দেয়া হয়েছে। তাতে রবি মৌসুমের ফলনও ভালো হয়েছে। কিন্তু ঋণের বিষয়টি চাহিদার ওপরও নির্ভর করে। নীতিমালা অনুযায়ী ব্যাংকগুলোকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ দিতেই হবে। তবে এখানে কোনো গ্যাপ তৈরি হয়ে থাকলে বিষয়টি দেখতে হবে এবং প্রয়োজনে পদক্ষেপ নিতে হবে।

Link copied!