নিজস্ব প্রতিবেদক
ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫, ১২:০৫ এএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৫, ১২:০৫ এএম
মুখ খুলেছে আসামিরা দিয়েছে বেশ কিছু তথ্যও
সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে স্মারকলিপি দেবে ডিআরইউ
ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের চাপে সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত বন্ধ ছিল—শিশির মনির, আইনজীবী
২০১২ সালের ফেব্রুয়ারির এক বিভীষিকাময় রাতে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার এবং মেহেরুন রুনিকে হত্যার পর থেকেই তদন্ত চলছে। তবে আদালতের নথি অনুসারে এখন পর্যন্ত জোড়া খুনের এই মামলার তদন্ত শেষ করতে পারেনি তদন্তকারী কর্মকর্তারা। ভুক্তভোগী পরিবার এই ঘটনায় হতাশা জানিয়ে বলেছেন, এটি তদন্তকারীদের ১৩ বছরের ব্যর্থতা।
৭৩ বছরের সাগরের মা সালেহা মনির গত ১৩ বছর ধরে ন্যায়বিচারের আশায় অপেক্ষা করছেন। কিন্তু তার অপেক্ষার পালা আর ফুরায় না। তিনি বলেন, ‘আমরা সবসময়ই ন্যায়বিচার চাই। কিন্তু বিচার পাচ্ছি কোথায়?’
‘এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে বড় কেউ রয়েছে। তাই এতদিন এটি প্রকাশ করা হয়নি। যদি কোনো চোর বা ডাকাত এটি করত, তবে অনেক আগেই এটি প্রকাশ পেত,’ বলেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমি তদন্তকারীদের একটা কথাই বলেছি, চুরি বা ডাকাতির অজুহাত দিও না। আমি সেটা মেনে নেব না।’
‘আমরা একেবারে অন্ধকারে আছি। কোনো আশা বা প্রত্যাশা নেই। পিবিআই এখন তদন্ত করছে। তারা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। দেখা যাক তারা কতদূর কী করতে পারে,’ বলেন সালেহা মনির।
হত্যার ঘটনায় ২০১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি শেরেবাংলা নগর থানায় জোড়া খুনের মামলা করেছিলেন রুনির ভাই নওশের আলম রোমান। গত বছর ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর এখন তিনি তদন্তকারীদের ওপর আস্থা রাখতে চান। নওশের বলেন, নতুন তদন্তকারী সংস্থা দায়িত্ব নেয়ার পর আমরা এখন কিছুটা আশার আলো দেখতে পাচ্ছি। প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য ছয় মাসের সময়সীমা আছে। ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে আমরা কতটা আশাবাদী তা ওই প্রতিবেদন থেকেই
বোঝা যাবে। সাগর সরওয়ার মাছরাঙা টিভির বার্তা সম্পাদক এবং তার স্ত্রী মেহেরুন রুনি এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার ছিলেন। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোরে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে ভাড়া বাসায় তাদের হত্যা করা হয়। বাসায় ছিল তখন তাদের তাদের একমাত্র সন্তান মাহির সরোয়ার মেঘ। যার বয়স ছিল মাত্র পাঁচ বছর। হত্যাকাণ্ডের পর আটজন সন্দেহভাজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তারা হলেন কামরুল ইসলাম ওরফে অরুণ, আবু সাঈদ, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মাসুম মিন্টু, পলাশ রুদ্র পাল, আনামুল হক ওরফে হুমায়ুন কবির এবং তানভীর রহমান খান। তানভীর ও পলাশ বর্তমানে কারাগারের বাইরে ও অন্যরা কারাগারে আছেন।
সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার ঘটনায় করা মামলার বাদীর আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেছেন, সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত শেখ হাসিনা সরকারের উচ্চপর্যায়ের ব্যক্তিরা বাধাগ্রস্ত করেছে। এ কারণে ১৩ বছর পার হলেও তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার আসার পর হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ মামলাটি তদন্তের জন্য উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স গঠন করেছে। আগামী ৪ এপ্রিলের মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিলের কথা রয়েছে। টাস্কফোর্সে যারা রয়েছেন, তারা মামলার বাদী, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছেন। তদন্তে অনেক দূর এগিয়ে গেছেন। তদন্ত কমিটির সংশ্লিষ্টরা আমাদের জানিয়েছেন, আগের সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে তদন্তে বাধা দেয়া হতো। এ কারণে তদন্ত আগায়নি।
গতকাল মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে সাংবাদিকদের কাছে তিনি এসব কথা বলেন। এ সময় মামলার বাদী নওশের রোমান, সাগর-রুনির ছেলে মাহির সারওয়ার মেঘ উপস্থিত ছিলেন। এর আগে গত বছরের ১৭ অক্টোবর হাইকোর্টের নির্দেশে সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার ঘটনায় করা মামলার তদন্তে পিবিআই প্রধানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের উচ্চপর্যায়ের টাস্কফোর্স কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিতে এডিশনাল ডিআইজি পদমর্যাদার নিচে নয় পুলিশের একজন প্রতিনিধি, সিআইডির একজন প্রতিনিধি ও র্যাবের একজন প্রতিনিধিকে রাখা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে টাস্কফোর্স গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার ঘটনায় করা মামলার তদন্তে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। তাদের ছয় মাসের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে বলা হয়। একই সঙ্গে মামলার তদন্ত থেকে র্যাবকে সরিয়ে দেয়ারও আদেশ দেন আদালত। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে এই নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। বিভিন্ন বাহিনীর অভিজ্ঞ তদন্ত কর্মকর্তাদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করতে বলা হয়। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের শুনানি নিয়ে সোমবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব উল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ এই আদেশ দেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আরশাদুর রউফ ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনীক আর হক। মামলার বাদীর পক্ষে অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ও রিটের পক্ষে অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ শুনানি করেন। এর আগে সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার ঘটনায় করা মামলার তদন্ত থেকে র্যাবকে সরিয়ে দিতে সম্পূরক আবেদন করা হয়। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে এ আবেদন করা হয়। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারে সাংবাদিক দম্পতি মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরওয়ার এবং এটিএন বাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেরুন রুনি তাদের ভাড়া বাসায় নির্মমভাবে খুন হন।
জানা যায়, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ভোররাতে রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের বাসায় নৃশংসভাবে খুন হন এ সাংবাদিক দম্পতি। এ ঘটনায় মামলা দায়েরের পর ১৩ বছর পেরিয়ে গেলেও কোনো সুরাহা হয়নি। কবে নাগাদ মামলার তদন্ত শেষ হবে বলতে পারছেন না তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। থানাপুলিশ-ডিবি-র্যাবের হাত ঘুরে বর্তমানে মামলার তদন্তভার পেয়েছে পিবিআই। সবমিলিয়ে চারবার বদল হয়েছে তদন্ত সংস্থা। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি দেখা যায়নি।
আদালত সূত্রে জানা যায়, তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এখন পর্যন্ত ১১৫ বার সময় নেয়া হয়েছে। সর্বশেষ গত ২৭ জানুয়ারি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিন ধার্য ছিল। তবে ওই দিন মামলার তদন্ত সংস্থা পিবিআই প্রতিবেদন দাখিল করতে পারেনি। পরে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জি এম ফারহান ইশতিয়াকের আদালত প্রতিবেদন দাখিলের পরবর্তী তারিখ ২ মার্চ ধার্য করেন।
সাগর-রুনি হত্যার বিচার দাবিতে স্মারকলিপি দেবে ডিআরইউ : সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনি হত্যার বিচার দাবিতে আজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে স্মারকলিপি দেবে সাংবাদিকদের সংগঠন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ)।
গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে সাগর-রুনি হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত সমাবেশ থেকে এ ঘোষণা দেন সংগঠনটির সভাপতি সভাপতি আবু সালেহ আকন।
সমাবেশে আবু সালেহ আকন বলেন, ‘এখানে আমরা যারা আছি, সবাই সাগর-রুনি হত্যার বিচার চাই। আগামী নতুন কমিটিতে যারা আসবেন, তারাও আশা করি এই হত্যার বিচার চাইবেন। যারা আমাদের আন্দোলন-সংগ্রামকে ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করতে চেয়েছেন, পকেটে টাকা ভরেছেন, সরকারের টাকায় বিদেশে গিয়েছেন, আলিশানভাবে থেকেছেন; ইনশাআল্লাহ তাদেরও বিচার করবে এই সাংবাদিক সমাজ।’ সমাবেশ থেকে সংগ্রাম পরিষদ গঠনের কথা এসেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা জেনেছি আগামী ২ মার্চ এই হত্যার প্রতিবেদন দাখিলের কথা রয়েছে। আমরা সেদিন পর্যন্ত দেখব। যদি ২ মার্চ এই হত্যার প্রতিবেদন দাখিল করা না হয়, তাহলে আমরা সংগ্রাম কমিটি গঠন করে রাস্তায় নামব এবং জোরালোভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ব। এছাড়া এই হত্যার বিচার দাবিতে আজ বুধবার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হবে।’
ডিআরইউ সভাপতি বলেন, ‘গত ১৩ বছরেও এই হত্যার বিচার হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকার যে ফ্যাসিস্ট ছিল তার প্রমাণ হচ্ছে এই হত্যার বিচারকে তারা ভিন্ন খাতে প্রভাবিত করেছে। এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে প্রভাবশালীরা জড়িত ছিল। তার প্রমাণ হচ্ছে, আমরা এখনও খুনিদের নাম জানতে পারিনি। সেই সময় শেষ হয়েছে, এখন আওয়ামী লীগ নেই। এখন বিপ্লবী সরকার ক্ষমতায়। আমরা তাদের কাছে আশা করছি এই হত্যার বিচার পাব। যদি না পাই, আপনারা মনে রাখবেন, কেয়ামত পর্যন্ত এই হত্যার বিচার দাবি করে যাব আমরা।’