ফেব্রুয়ারি ১৪, ২০২৫, ১২:১০ এএম
দেশের বড় তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ আছে— ভূতত্ত্ববিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যপক ড. বদরুল ইমাম
বাংলাদেশের গ্যাস খাতে সংকট প্রকট হতে পারে, সেটা অনেক আগেই বলা হয়েছে— ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম
দিন দিন জ্বালানির চাহিদা বেড়েই চলছে। বিদ্যুৎ এবং শিল্প খাতে গ্যাস সংকট আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। ২০১৫ সালে যেখানে দেশীয় উৎস থেকে গ্যাসের জোগান ছিল দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট, গত ৯ বছরে তা কমে হয়েছে ২২২ কোটি ঘনফুট। দেশের গ্যাস অনুসন্ধানে ধীরগতি ও এলএনজি আমদানি নির্ভরতা— জ্বালানি খাতে বড় সংকট তৈরি করেছে। চাহিদা অনুসারে গ্যাস না পাওয়ায় শিল্প, বাণিজ্য ও বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পিছিয়ে পড়ছে অর্থনীতি।
আসন্ন গ্রীষ্ম ও রমজানে বিদ্যুতের ঘাটতি সামাল দিতে উচ্চ মূল্যে এলএনজি আমদানি করতে যাচ্ছে সরকার। এছাড়া বিকল্প উপায়ও নেই। এমন পরিস্থিতিতে সরকার বিদ্যুৎ ঘাটতি সামাল দিতে বেশি দামের এলএনজির ওপর নির্ভরতা বাড়াচ্ছে। সেজন্য গ্যাস সরবরাহ ঠিক রাখতে জ্বালানি বিভাগ এলএনজি আমদানি বাড়াতে যাচ্ছে।
মূলত গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দিয়ে ঘাটতি মোকাবিলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। লোডশেডিং সামাল দিতে শুধু রমজানের জন্য বাড়তি চার কার্গো এলএনজি কেনার অতিরিক্ত প্রাক্কলন করা হয়েছে। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারে গত আট মাসে কয়লার দাম কমেছে প্রায় ১৭ শতাংশ। একই সময়ে স্পট মার্কেটে প্রায় ১৮ শতাংশ বেড়েছে এলএনজির দাম। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
দেশে ব্যবহৃত জ্বালানির ৪১ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস। দিন দিন গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। ২০৩০ সালে চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে দৈনিক ৬৬৫ কোটি ঘনফুট। ওই সময় দেশীয় ক্ষেত্রগুলো থেকে পাওয়া যেতে পারে ২২২ কোটি ঘনফুট। আমদানি করা এলএনজি (তরলকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) থেকে মিলবে ২১৩ কোটি ঘনফুট। তারপরও দিনে ২৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকবে। বর্তমানে এলএনজি থেকে মেলে দিনে গড়ে ৭০ কোটি ঘনফুট। চাহিদা মেটাতে ২০৩০ সালে বর্তমানের চেয়ে তিন গুণের বেশি এলএনজি আমদানি করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকার রমজানের পাশাপাশি গ্রীষ্ম মৌসুমেও বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে নানা পরিকল্পনা নিয়েছে। কারণ তখন দৈনিক ৭০০ থেকে এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে। পরিস্থিতি সামাল দিতে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দিয়ে ঘাটতি মোকাবিলার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সেজন্য এলএনজি আমদানি বাড়াতে যাচ্ছে জ্বালানি বিভাগ। বিদ্যুৎ ঘাটতি মোকাবিলায় বিগত সরকারও এলএনজিকে গুরুত্ব দিয়েছিল। তবে একপর্যায়ে দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় সরকার পণ্যটির আমদানি বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বড় আকারে ঘাটতি তৈরি হয়। ব্যাপক হারে বেড়ে যায় দেশজুড়ে লোডশেডিংয়ের মাত্রাও। তারপরও বিদ্যুতে ঊর্ধ্বমুখী দামের জ্বালানি পণ্যের ওপর নির্ভরতা বাড়ানো হচ্ছে। তাতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) আর্থিক চাপও বাড়বে।
সূত্র জানায়, বিদ্যুতের চাহিদা আসন্ন রমজানে ১৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট তৈরি হবে। ওই সময় গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় দিনে এক হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। বর্তমানে দৈনিক ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো সরবরাহ হচ্ছে। অতিরিক্ত ৩০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করে সরবরাহ করা হবে। জ্বালানি বিভাগ শুধু রমজানের জন্য বাড়তি চার কার্গো এলএনজি কেনার অতিরিক্ত প্রাক্কলন করেছে।
আসন্ন রমজান ও গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ আগামী জুনের মধ্যে পর্যায়ক্রমে চার বিলিয়ন ডলার চেয়েছে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ তিন বিলিয়ন ডলার এবং বাকি অর্থ জ্বালানি আমদানি, অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ফার্নেস অয়েল ও গ্যাস আমদানির জন্য। একই সঙ্গে ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বৈঠকও করেন। সেখানেই এ অর্থ চাওয়া হয়।
সূত্রে আরও জানায়, বিশ্ব বাজারে এখন নিম্নমুখী কয়লার দাম। জ্বালানিটির দাম গত আট মাসে টনপ্রতি প্রায় ১৭ শতাংশ কমেছে। একই সময় আবার স্পট মার্কেটে ক্রমেই বেড়েছে এলএনজির দাম। গত আট মাসে স্পট মার্কেটে এলএনজির দাম প্রায় ১৮ শতাংশ বেড়েছে। সামনে এ দাম আরও ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার জোরালো সম্ভাবনাও রয়েছে। এদিকে দেশে বড় পাঁচটি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে রয়েছে। সেগুলোর মোট সক্ষমতা ছয় হাজার ৭৮৭ মেগাওয়াট। জ্বালানি সংকটের কারণে ব্যবহার করা যায় না ওসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের অর্ধেক সক্ষমতা। শীত মৌসুমে ওসব কেন্দ্রের উৎপাদন দুই-আড়াই হাজার মেগাওয়াটে নেমে আসে। গ্রীষ্মে অন্তত পাঁচ হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর পরিকল্পনা রয়েছে বলে বিপিডিবি জানিয়েছে। তবে বিষয়টি অর্থের ওপর নির্ভর করছে। প্রয়োজনীয় অর্থ পাওয়া গেলেই কয়লাভিত্তিক কেন্দ্রগুলো চালানো হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এ বিষয়ে জানিয়েছেন, শুধু যে এলএনজি আমদানি করে লোডশেডিং কমানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে, তা নয়। কয়লা ও গ্যাস দুটো পণ্যই আমদানি করা হবে। তবে রমজানে বিদ্যুতের চাহিদার প্রাক্কলন বেশি হওয়ায় তাৎক্ষণিকভাবে বিদ্যুতের ঘাটতি মোকাবিলার চেষ্টায় গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। তাতে বাড়তি এলএনজি কার্গো আমদানি করা হবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কয়লা ও এলএনজি দুটো পণ্যই আমদানি করতে হবে। লজিস্টিকস সাপোর্টের বিষয়ে কয়লার চেয়ে এলএনজি ভালো। সরকারের লক্ষ্য জ্বালানির জোগানটা নিরবচ্ছিন্ন রাখা এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন সাশ্রয়ী করা।
২০৩০ সালে এলএনজি আমদানি বাড়বে তিন গুণ : দেশে ব্যবহূত জ্বালানির ৪১ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস। দিনদিন গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। ২০৩০ সালে চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে দৈনিক ৬৬৫ কোটি ঘনফুট। ওই সময় দেশীয় ক্ষেত্রগুলো থেকে পাওয়া যেতে পারে ২২২ কোটি ঘনফুট। আমদানি করা এলএনজি (তরলকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) থেকে মিলবে ২১৩ কোটি ঘনফুট। তারপরও দিনে ২৩০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকবে। বর্তমানে এলএনজি থেকে মেলে দিনে গড়ে ৭০ কোটি ঘনফুট। চাহিদা মেটাতে ২০৩০ সালে বর্তমানের চেয়ে তিন গুণের বেশি এলএনজি আমদানি করতে হবে।
গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের একটি প্রক্ষেপণ তৈরি করেছে পেট্রোবাংলা। এতে বলা হয়, ২০২৯-৩০ অর্থবছরে দিনে গ্যাসের চাহিদা হতে পারে ৬৬৫ কোটি ঘনফুট। তবে বিতরণ কোম্পানির মতে, এ সময়ে গ্যাসের চাহিদা হবে ৫০৯ কোটি ঘনফুট। ওই চাহিদার বিপরীতে ৪৩৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হতে পারে বলে মনে করছে পেট্রোবাংলা। এর মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে ২১২ কোটি, এলএনজি থেকে ২১৩ কোটি ও সমুদ্র থেকে ১০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন ধরা হয়েছে। তবে সমুদ্রে এখন পর্যন্ত কোনো গ্যাস আবিষ্কৃত হয়নি।
বঙ্গোপসাগরে গ্যাসের ব্যাপক সম্ভাবনার কথা জানান পেট্রোবাংলার সাবেক কর্মকর্তা মো. ফরিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, সমুদ্রে মার্কিন কোম্পানি কনোকোফিলিপসের চালানো দ্বিমাত্রিক জরিপের তথ্য তিনি দেখেছেন। এতে ৭ টিসিএফ গ্যাসের সম্ভাবনা কথা বলা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামেও বেসরকারি খাতকে দিয়ে দ্রুত অনুসন্ধান শুরু করা দরকার।
ভূতত্ত্ববিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যপক ড. বদরুল ইমাম বলেন, মজুতের হিসাব সব সময় একই থাকে না। নতুন কূপ খনন করা হলে গ্যাসের মজুত কোনো কোনো ক্ষেত্রে কমতে পারে। তবে অধিকাংশ সময়ই বাড়ে। তাই মজুতের তথ্য নিয়মিত হালনাগাদ করতে হয়। ১৪ বছর হালনাগাদ না করাটা অস্বাভাবিক। তিনি আরও বলেন, দেশের বড় তিনটি গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন বাড়ানোর সুযোগ আছে। কিন্তু তা না করে এলএনজি আনার দিকে ঝোঁকটা বেশি দেখা যায়।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন, ভুলনীতি আর দুর্নীতির ওপর ভর করেই চলছে দেশের জ্বালানি খাত। আমলা দিয়ে প্রতিষ্ঠান চালিয়ে কখনোই জনগণের স্বার্থ রক্ষা হবে না। তিনি বলেন, ২০২৫-২৬ সালের দিকে যে বাংলাদেশের গ্যাস খাতে সংকট প্রকট হতে পারে, সেটা অনেক আগেই বলা হয়েছে। তবু পেট্রোবাংলা কার্যত তেমন উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।