Amar Sangbad
ঢাকা শুক্রবার, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫,

কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে বালাইনাশকের বাজার

আমার সংবাদ ধর্ম ডেস্ক

ফেব্রুয়ারি ১৯, ২০২৫, ১২:১৮ এএম


কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে বালাইনাশকের বাজার
  • দেশে বালাইনাশকের বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার

  • প্রান্তিক কৃষকরা বালাইনাশক বহুগুণদামে কৃষিকাজে ব্যবহার করছে

বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে দেশের বালাইনাশকের বাজার। মূলত বিদ্যমান নিয়মনীতির কারণেই এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। বালাইনাশক নির্ভরতা বাংলাদেশের কৃষির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলেও তা মূলত ফসলের ক্ষতিকর উদ্ভিদ বা প্রাণী দমনে ব্যবহূত হয়। দেশে বালাইনাশকের বাজার প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকার। আর কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানি তার বেশিরভাগ নিয়ন্ত্রণ করে। 

মূলত দেশের নিয়মনীতিই ওসব কোম্পানিকে একচেটিয়া ব্যবসা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। বালাইনাশকের ক্ষেত্রে দেশীয় কোম্পানিগুলোর জন্য নানা নিয়ম থাকলেও বহুজাতিক কোম্পানিকে বহুবিধ সুযোগ দেয়া হচ্ছে। ওসব কোম্পানি উচ্চমূল্যে ফিনিশড পণ্য (কাঁচামাল থেকে উৎপাদিত সম্পূর্ণ পণ্য) আমদানি করে আরও বেশি মূল্যে দেশীয় বাজারে বিক্রি করে। আর প্রান্তিক কৃষকরা ওসব বালাইনাশক বহুগুণ দামে কৃষিকাজে ব্যবহার করছে। কৃষি এবং শিল্প মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। 

সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বর্তমানে দেশে সাতটি বহুজাতিক কোম্পানি ফিনিশড পণ্য আমদানি করে। তা বাইরে একইভাবে ২২টা দেশীয় কোম্পানি বালাইনাশক উৎপাদন করতে পারে। কিন্তু বিটাক দেশীয় কোম্পানির বেলায় নানা ধরনের শর্ত আরোপ করে রেখেছে। যার মাধ্যমে বিদেশি কোম্পানিগুলো একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ পাচ্ছে। তবে এতদিন ওসব সিদ্ধান্ত কেবল পিটাক কর্তৃক প্রণীত সিদ্ধান্ত ছিল। তবে কৃষি এবং আইন মন্ত্রণালয় ওসব সিদ্ধান্ত বদলের সুপারিশ করেছিল। কিন্তু পিটাক তা আমলে নেয়নি। সর্বশেষ কৃষি মন্ত্রণালয় এ-সংক্রান্ত বিষয়ে বিধি প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। যার মাধ্যমে বালাইনাশকের বাজার বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর জন্য নানা সুযোগ-সুবিধা নতুন করে বিধিবদ্ধ আইনে পরিণত করা হবে। 

সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বালাইনাশকের কাঁচামাল এবং ফিনিশড বালাইনাশক আমদানি করা হয়। তারপর বিভিন্ন হাত ঘুরে নানা প্রক্রিয়া শেষে তা দেশীয় বাজারে যায়। যার বিক্রির পরিমাণ ১৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি। ফিনিশড পণ্যের অন্তত ৮০ ভাগ আমদানি করা হয় চীন থেকে এবং ভারতসহ অন্যান্য দেশ থেকে ২০ ভাগ আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ১০ ভাগ কাঁচামাল এবং বাকিগুলো ফিনিশড পণ্য। বহুজাতিক কোম্পানি সিনজেনটা বাংলাদেশ লিমিটেড সবচেয়ে বেশি বালাইনাশকের ফিনিশড পণ্য আমদানি করে। এদেশে কোম্পানিটির প্রতি বছর প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি টাকারও বেশি ব্যবসা রয়েছে। 

বাংলাদেশ সরকারের শিল্প মন্ত্রণালয়ের কোম্পানিটির ৪৬ ভাগ মালিকানা রয়েছে। তার বাইরে জার্মানভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি বায়ার ক্রপসায়েন্স প্রতি বছর প্রায় ৪০০ থেকে ৫০০ কোটি টাকার ফিনিশড পণ্যের ব্যবসা করে। আর ভারতীয় বহুজাতিক কোম্পানি ইউপিএল, জার্মানভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি বিএএসএফ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বহুজাতিক কোম্পানি এফএমসি কর্পোরেশন পরোক্ষভাবে এখানে বালাইনাশকের ব্যবসা করছে।

সূত্র আরও জানায়, কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে অবাধ এবং সহজ করা হলে বালাইনাশকের দাম কমপক্ষে ৩০ ভাগ কমে কৃষকরা হাতে পেতো। যদিও বাংলাদেশ নিম্ন আয়ের দেশ হওয়ার কারণে ওষুধ এবং বালাইনাশকের একচেটিয়া বাজার করার সুযোগ নেই। জাতীয় সংসদে এ সংক্রান্ত আইনও রয়েছে। কিন্তু ওই আইনকে তোয়াক্কা না করে পিটাক সভায় একচেটিয়া বাজার সৃষ্টিকে সমর্থন করে দেশের কৃষকদের অধিকার বঞ্চিত করছে। বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে দেশীয় বাজারে একচেটিয়া প্রভাব তৈরিতে সহায়তা দিচ্ছে বালাইনাশক কারিগরি উপদেষ্টা কমিটি (পিটাক)। আর দেশীয় কোম্পানিগুলোকে নানা নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ করে আটকে রাখা হচ্ছে। একসময় রেজিস্ট্রার্ড বালাইনাশকের সংখ্যা ছিল ৩০০। পরে তা ১২ হাজার অতিক্রম করে। এমনকি নতুন করে প্রায় তিন হাজার ৮০০ এর বেশি আবেদন জমা পড়েছে। ওই বিপুলসংখ্যক বালাইনাশকের ল্যাব টেস্ট করতে তিন শতাধিক যন্ত্র দরকার। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের ওই পরিমাণ সক্ষমতা নেই। তেমন টেস্ট করার মতো মাত্র দুটি যন্ত্র রয়েছে। 

অভিযোগ রয়েছে, সোর্স উন্মুক্ত না রেখে কয়েকটি কোম্পানিকে লাভবান করার লক্ষ্যে কাজ করছে কিছু কর্মকর্তা। আগে যে কোনো কীটনাশক রাসায়নিক পরীক্ষায় ফলাফল যথাযথ থাকলে কোম্পানিগুলো সোর্স পরিবর্তন করতে পারতো। অর্থাৎ বিদেশের যে কোনো কোম্পানি থেকে কাঁচামাল বা ফিনিশড পণ্য আমদানি করা যেত। ল্যাব টেস্টে উত্তীর্ণ হলেই সোর্স পরিবর্তনের সুযোগ পাওয়া যেত। ওই সময় বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বালাইনাশকের সোর্স ছিল ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড এবং জার্মানি। এখন তারা সোর্স হিসেবে ভারত এবং চীনসহ আশপাশের দেশগুলোতে নিয়ে আসে। পিটাক সভায় দেশীয় কোম্পানির ক্ষেত্রে সোর্স পরিবর্তনের জন্য ল্যাব টেস্টের পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের পরীক্ষার শর্ত আরোপ করা হয়। কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানির ক্ষেত্রে কেবল কান্ট্রি অব অরিজিন পরিবর্তনের মাধ্যমেই সোর্স পরিবর্তনের সুযোগ দেয়া হয়। আর সোর্স পরিবর্তন বন্ধ করায় ক্ষতির মুখে পড়ছে মূলত দেশীয় কোম্পানিগুলো। কারণ নির্দিষ্ট কোম্পানি দাম বেশি রাখলেও ওই কোম্পানির বাইরে অন্য কোনো কোম্পানি কিংবা দেশ থেকে কাঁচামাল বা ফিনিশড পণ্য আমদানি করার সুযোগ নেই। আর বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এই সুযোগটাই নিয়েছে। কারণ তারা কান্ট্রি অব অরিজিন পরিবর্তন করেই সোর্স পরিবর্তন করতে পারে।

এদিকে কৃষি কর্মকর্তাদের মতে, সালফার ৮০ ডব্লিউডিজি নামের বালাইনাশক জমিতে সালফারের ঘাটতি পূরণ ও পোকামাকড় দমনে সাহায্য করে। কৃষক সাধারণত নানা ফসলের জন্য ব্যাপকভাবে ওই বালাইনাশকটি ব্যবহার করে। সিনজেনটা এই কীটনাশক প্রতি কেজি ১ দশমিক ৫৪ ডলারে আমদানি করলেও একই পণ্য দেশীয় কয়েকটি কোম্পানি মাত্র শূন্য দশমিক ৪৭ ডলারে আমদানি করেছে। একইভাবে এমামেকটিন বেনজোয়েট ৫ এসজি হলো কৃষিক্ষেত্রে বহুল ব্যবহূত একটি কীটনাশক। ওই কীটনাশক বিশেষভাবে লেপিডোপটেরা গোত্রের পোকামাকড় দমনে কার্যকর। ওই বালাইনাশক সিনজেনটা আমদানি করেছে প্রতি কেজি ৩৩ দশমিক ৬৪ ডলারে আর দেশীয় ফিনিশড পণ্য আমদানিকারক কয়েকটি কোম্পানি তা মাত্র ৫ দশমিক শূন্য ২ ডলারে আমদানি করেছে। কেবল সিনজেনটাই নয়, অন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এভাবেই বেশি দামে বালাইনাশকের ফিনিশড পণ্য আমদানি করে থাকে। যার প্রভাব কৃষকদের ওপর পরে। বাড়তি দামে ওসব বালাইনাশক কিনতে বাধ্য হয় কৃষক।

অন্যদিকে এসব বিষয়ে বিধি প্রণয়ন কমিটিতে আমন্ত্রিত এবং অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মাহাবুব কবির মিলন জানান, বালাইনাশক আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় শিল্প বিকাশের সুযোগ তৈরি করতে হবে। সিঙ্গেল সোর্সে বালাইনাশক আমদানি করলে মূলত একটা গোষ্ঠীর সুবিধা হয়। এটা ভেঙে দিতে হবে। দেশেই বালাইনাশক উৎপাদন শিল্প চালু করতে হবে। তাতে ডলার খরচ কমার পাশাপাশি কোয়ালিটি প্রডাক্ট হবে এবং কর্মসংস্থান বাড়বে। 

এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (উপকরণ) মো. জসিম উদ্দিন জানান, বালাইনাশক আমদানির ক্ষেত্রে সোর্স কীভাবে হবে সে বিষয়ে বিভিন্ন উইংয়ের সঙ্গে বৈঠক করা হচ্ছে। সবার মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

Link copied!