Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫,

প্রথমবারের মতো ‘শহীদ সেনা দিবস’ পালিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

ফেব্রুয়ারি ২৬, ২০২৫, ১২:১০ এএম


প্রথমবারের মতো ‘শহীদ সেনা দিবস’ পালিত

যারা দোষী তারা যেন সামনে আসে, যেন সুষ্ঠু বিচারটা হয়—স্বজনের আর্তি

২০০৯ সালে পিলখানায় সংঘটিত বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেছেন রাষ্ট্রপতির প্রতিনিধি, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, তিন বাহিনী প্রধান ও নিহতদের স্বজনরা। 

গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে শহীদ সেনা কর্মকর্তাদের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে এই পুষ্পস্তবক অর্পণ করা হয়। এ সময় পিলখানায় সংঘটিত নির্মম হত্যাকাণ্ডে শাহাদাতবরণকারী কর্মকর্তাদের স্মরণ করে দোয়া করা হয়। তৎকালীন বাংলাদেশ রাইফেলসের (বিডিআর) সদর দপ্তর পিলখানায় বিদ্রোহের সময় সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় হাইকোর্টে রায় ঘোষিত হয়েছে। পরে নিয়ম অনুসারে রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আবেদন জানান সাজাপ্রাপ্ত আসামি ও রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। ফলে এখনও শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ এই মামলার আপিল বিভাগের বিচার।

২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার পিলখানায় সেনা সদস্যদের হত্যার ঘটনা ঘটে। সেখানে ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ মারা যান ৭৪ জন। হত্যার এই ঘটনাকে ‘জাতীয়ভাবে স্বীকৃতি’ ও ‘শহীদ সেনা দিবস’ হিসেবে পালনের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল শহীদ সেনা পরিবারের। সেটি বিগত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার কর্ণপাত করেনি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার ২৫ ফেব্রুয়ারিকে ‘জাতীয় শহীদ সেনা দিবস’ ঘোষণা করে। ফলে এর মধ্য দিয়ে শহীদ সেনা পরিবারের দীর্ঘদিনের দাবি আর আক্ষেপ ঘুচল। একই সঙ্গে তাদের মনে নতুন করে আশা জাগল হত্যার ঘটনায় জড়িতদের সঠিক বিচার পাওয়ার। সেই আশা নিয়েই এবার এক ‘ভিন্ন আবহে’ শহীদ পরিবারগুলো স্মরণ করেন শহীদ সেনা সদস্যদের। প্রথমবারের মতো এবার পালন হওয়া এই দিবসের শুরুতে ঢাকার বনানীর সামরিক কবরস্থানে নিহত সেনাসদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে শহীদ মেজর মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী রিতা রহমান জুলি বলেন, আমরা খুব বেশি কিছু চাইনি। চেয়েছি শহীদি মর্যাদা এবং বিচারটা সুষ্ঠুভাবে হোক। যারা দোষী তারা যেন সামনে আসে, যেন সুষ্ঠু বিচারটা হয়।

২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। এদিন সকাল ৯টার পরপরই পিলখানা বিডিআর সদর দপ্তরে গুলির শব্দ শোনা যেতে থাকে। বিডিআর সপ্তাহ চলার কারণে প্রথমে অনেকেই ভেবেছিলেন কোনো কর্মসূচি চলছে। কিন্তু কিছু সময় পর জানা যায় বিদ্রোহ হয়েছে; পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জওয়ানরা। বিদ্রোহের পর সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানরা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে বসেন। এরই মধ্যে পিলখানার চারদিকে সেনাবাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে অবস্থান নেয়। 

এদিকে পিলখানার পর দেশের বিভিন্ন জেলায় বিডিআর দপ্তরে বিদ্রোহের খবর আসতে থাকে। একপর্যায়ে সরকারের পক্ষ থেকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে শুরু হয় আলোচনা। তখনকার স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, হুইপ মীর্জা আজম ও সংসদ সদস্য শেখ ফজলে নূর তাপস এ আলোচনার নেতৃত্ব দেন। বিকালে শেখ হাসিনার সঙ্গেও বিদ্রোহীদের আলোচনা হয়। পরে পিলখানার প্রধান ফটকের পাশের একটি রেস্তোরাঁয় আলোচনায় অংশ নেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন। গভীর রাতে তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন পিলখানায় গেলে বিদ্রোহীরা তার কাছে অস্ত্র সমর্পণ করেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বেরিয়ে আসার সময় বিদ্রোহীদের হাতে জিম্মি কয়েকজন সেনা কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে করে বাইরে নিয়ে আসেন। তারা মুক্ত হন। কিন্তু এরপরও পিলখানা বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখা যায়। 

একপর্যায়ে ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকাল থেকে পিলখানা শূন্য হয়ে পড়লে পুলিশ ও সেনাবাহিনী পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নেয়। অবসান ঘটে প্রায় ৩৩ ঘণ্টার বিদ্রোহের। পরে ওই ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি পৃথক মামলা হয়। বিস্ফোরক মামলাটি এখনও বিচারিক আদালতে চলমান। তবে হত্যা মামলার বিচারিক কার্যক্রম শেষে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর ঢাকার অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. আখতারুজ্জামান বকশীবাজারের আলিয়া মাদ্রাসা মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী এজলাসে রায় ঘোষণা করেন। পিলখানা বিদ্রোহের ঘটনায় সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যার দায়ে ১৫২ আসামির ফাঁসির রায় দেন এই বিচারক। 

এ সময় তিনি বলেন, দেশের সামরিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা ধ্বংস করার উদ্দেশ্য নিয়ে পিলখানায় সেই বিদ্রোহ ঘটানো হয়েছিল। ন্যায্যমূল্যে পণ্য বিক্রির মতো কাজে বিডিআরকে জড়ানো ঠিক হয়নি বলেও রায়ের পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন তিনি। এরপর নিয়ম অনুসারে মামলার রায়ের সব নথিসহ আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিল হাইকোর্টে আসে। সেসব আবেদনের শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ২৬ ও ২৭ নভেম্বর টানা দুই দিনে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলায় হাইকোর্ট রায় ঘোষণা করেন। 

হাইকোর্টের রায়ে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ১৫২ আসামির মধ্যে ১৩৯ জনের ফাঁসির রায় বহাল রাখা হয়। একইসঙ্গে আট জনের মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন ও চারজনকে খালাস দেয়া হয়। অপরদিকে এ মামলার অন্যতম আসামি বিএনপি নেতা নাসিরউদ্দিন পিন্টু হাইকোর্টে বিচার চলাকালীন সময়ে মারা যান। পাশাপাশি বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন পাওয়া ১৬০ জন আসামির মধ্যে ১৪৬ জনের সাজা বহাল রাখেন হাইকোর্ট। তাদের মধ্যে দুই আসামি মারা যান এবং ১২ জনকে খালাস দেয়া হয়। 

এছাড়া জজ আদালতে খালাস পাওয়া ৬৯ আসামির মধ্যে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। তবে হাইকোর্টের রায়ের পর থেকে এ পর্যন্ত সাজাপ্রাপ্ত সব আসামি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেছেন বলে জানিয়েছেন তাদের অন্যতম আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম। 

তিনি বলেন, মামলাটি গত বছরে যেমন ছিল এখনও তেমনই আছে। আমাদের (আসামিপক্ষে) ও রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেয়া আছে। শুনানির জন্য মামলাটি কার্যতালিকাতেও আছে। 

আমাদের দাবি ছিল, মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি করার। বিগত সরকারের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের সঙ্গে মামলাটি দ্রুত শুনানির বিষয়ে আলোচনা হয়। কিন্তু এখন বর্তমান সরকার কী পদক্ষেপ নেবে তা নিয়ে কথা হয়নি। আমরা চাই, মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তি হোক। তারা প্রায় ১৬ বছর ধরে কারাগারে আছেন। হাইকোর্টের রায়ে আমরা ন্যায়বিচার পাইনি, তাই আপিল করা হয়েছে। 

এদিকে পিলখানায় সেনা অফিসারদের হত্যার ঘটনা তদন্তের জন্য চলতি বছর বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়। রিট আবেদনে বিডিআর বিদ্রোহের দিনকে ‘সৈনিক শহীদ দিবস’ এবং হতাহতদের ক্ষতিপূরণের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ ও বিপ্লব পোদ্দার এই রিট আবেদন করেন। 

আইনজীবী মো. তানভীর আহমেদ বলেন, গত বছরের ৫ আগস্টের পর যেহেতু ওই ঘটনাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন তথ্য উঠে এসেছে, অনেক প্রশ্ন উঠছে, সেহেতু আমরা মনে করি, আগে দায়ের হওয়া মামলায় সবকিছু পুরোপুরি উঠে আসেনি। সে কারণেই উত্থাপিত সব প্রশ্নের উত্তর ও সার্বিক তদন্তের মাধ্যমে যেন পূর্ণাঙ্গ বিষয়টি তুলে ধরা হয়, সে জন্য আমরা রিট দায়ের করেছিলাম। আমাদের রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল জারি করেন। পাশাপাশি স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠিত হয়। আমরা কমিশনের প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছি। প্রতিবেদন পেলে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবো।

Link copied!