নিজস্ব প্রতিবেদক
ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৫, ১২:১১ এএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২৫, ১২:১১ এএম
গ্যাসের দাম নিয়ে গণশুনানি : তোপের মুখে বিইআরসি
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব গণবিরোধী, এটি হবে জাতীয় দুর্ভাগ্য—শামসুল আলম
গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক-অবাস্তব—মোহাম্মদ হাতেম
নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলা। গতকাল বুধবার রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত গণশুনানিতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর পক্ষে পেট্রোবাংলা এই প্রস্তাব উত্থাপন করে। গণশুনানির আয়োজন করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
পেট্রোবাংলার প্রস্তাব অনুসারে নতুন শিল্পকারখানার বয়লার ও শিল্প কারখানার জেনারেটরে (ক্যাপটিভ) সরবরাহ করা গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১.৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা, প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের (ইতোমধ্যে অনুমোদিত) গ্যাসের অর্ধেক বিল বিদ্যমান দরে, অর্ধেক ৭৫.৭২ টাকা করতে হবে। এই প্রস্তাবের ওপর শুনানি চলছে।
যদিও ব্যবসায়ীরা গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিরোধিতা করে বলছেন, বিতরণ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রস্তাব মেনে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে দেশের শিল্পকারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে ও দেশ আমদানি নির্ভর হয়ে পড়তে পারে।
গত রোববার সাশ্রয়ী দামে জ্বালানি ও শিল্প উৎপাদনে এর প্রভাব শীর্ষক সেমিনারে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, গ্যাসের দাম দ্বিগুণ করার বিষয়ে সরকারের পরিকল্পনা পণ্যের উৎপাদন খরচ অনেক বাড়িয়ে দেবে। শিল্পকারখানাগুলোকে অপ্রতিযোগিতামূলক করার পাশাপাশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির বিষয়ে গণশুনানিতে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)।
বুধবার রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই শুনানিতে শিল্পোদ্যোক্তারা এর বাতিলের দাবি জানান। একই সঙ্গে, ভোক্তা সংগঠন ক্যাব আগামী রোববারের মধ্যে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করার আহ্বান জানায়।
দেশে চাহিদার তুলনায় গ্যাসের জোগান কমপক্ষে ২৫ ভাগ কম। শিল্পের বর্ধিত চাহিদা পূরণে আপাতত এলএনজি আমদানিই ভরসা। এতে প্রতি ইউনিটে খরচ পড়ে ৭২ টাকার ওপরে। এজন্য বিতরণ, সঞ্চালন কমিশনসহ নতুন শিল্পকারখানার বয়লার ও শিল্পকারখানার জেনারেটরে সরবরাহ করা প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১ দশমিক ৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ দশমিক ৭২ টাকার প্রস্তাব করে পেট্রোবাংলা। এরইমধ্যে প্রতিশ্রুতি পাওয়া শিল্পের অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে এবং পুরোনো শিল্পের অনুমোদিত লোডের বেশি গ্যাসের ওপর এই দর কার্যকরের প্রস্তাব তাদের।
কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই শিল্প মালিকরা দর বৃদ্ধির প্রস্তাব খারিজ করার দাবি জানান। তারপরও বুধবার সকালে রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে শুনানি শুরু করে বিইআরসি। তখন অংশীজনরা তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, গ্যাসের দাম বাড়ালে হুমকির মুখে পড়বে বিনিয়োগ ও আর শিল্প খাত।
নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেছেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব অযৌক্তিক ও অবাস্তব। এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকেন। গতকাল দুপুরে রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আয়োজিত শিল্পে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত গণশুনাতিতে একথা বলেন তিনি।
বিকেএমইএ সভাপতি বলেন, শিল্পে আমাদের যখন প্রাকৃতিক গ্যাস দেয়া হয়, আমরা ১৫ পিএসআই বা ৪০ পিএসআই নিয়ে থাকি কিন্তু ২ বা ৩ পিএসআইর বেশি পাইনি। তিতাসের রিপোর্টে দেখেছি ৪০ শতাংশ সিস্টেম লস, মানে চুরি। গ্যাসের চুরির কারণে বাকি চাপ আমাদের ওপর আসে। এখন উনারা (তিতাস) বলছে, ৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছেন।
মোহাম্মদ হাতেম বলেন, নারায়ণগঞ্জে আপনারা দেখবেন হাজার হাজার অবৈধ চুলা, সেগুলো চলছে। সবগুলোর সঙ্গে তিতাস জড়িত। সিস্টেম লস কমালে মূল্যবৃদ্ধির চিন্তা করতে হতো না। এখনো তিতাসের হিসাবে ১৩ শতাংশ সিস্টেম লস। ১ শতাংশ সিস্টেম লস কমালে এক হাজার কোটি টাকা সেফ হয়।
তিনি আরও বলেন, বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানির পর আমদানি মূল্যের ওপর সরকার ভ্যাট বসিয়ে ব্যবসা করছে। মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ১২ টাকার গ্যাস আমাদের থেকে ৩০ টাকা নিচ্ছে। এখন ৩০ টাকার গ্যাস যদি ৭৫ টাকা নেয়া হয়। যদিও বলছে পুরোনো গ্রাহকদের দাম বাড়বে না। কিন্তু আমাদের ক্যাপাসিটি বাড়াতে হলে নতুন সংযোগ নিতে হবে। আমাদের প্রতিযোগিতা বাইরের দেশের সঙ্গে। এখন বেশি দামে গ্যাস কিনলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। তখন আর আমরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারব না।
গণশুনানিতে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ, সদস্য (অর্থ, প্রশাসন ও আইন) মো. আব্দুর রাজ্জাক, সদস্য (গ্যাস) মো. মিজানুর রহমান, সদস্য পেট্রোলিয়াম ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া, সদস্য (বিদ্যুৎ) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মোহাম্মদ শাহিদ সারওয়ার উপস্থিত আছেন।
গণশুনাতিতে ব্যবসায়ী, শিল্পকারখানার মালিক, ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা, সাংবাদিক, আইনজীবী, অ্যাক্টিভিস্টসহ আরও অনেকে উপস্থিত আছেন। এর আগে শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজসম্পদ করপোরেশনসহ (পেট্রোবাংলা) দেশের ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানি। তাদের প্রস্তাবের ভিত্তিতে গণশুনানি করে বিইআরসি। চলতি বছরের শুরুতে পাইকারি গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় পেট্রোবাংলা। এরপর তিতাস গ্যাস কোম্পানিসহ সরকারি ছয়টি বিতরণ কোম্পানি খুচরা গ্রাহকপর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর আবেদন করে। আবেদনে শিল্পকারখানায় ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা এবং ক্যাপটিভের দাম ৩১ টাকা ৫০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়। গ্যাসের দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে জানানো হয়, গ্যাসের দাম বাড়ানো না হলে এলএনজি আমদানি করতে গিয়ে চলতি বছর সরকারকে বিশাল টাকা ভর্তুকি দিতে হবে। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। দেশি গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে আসছে অর্ধেকের মতো। আর ২৫ শতাংশ এলএনজি আমদানি করে জোগান দেয়া হচ্ছে। গণশুনানিতে পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রতি ঘনমিটার এলএনজির বর্তমান আমদানি মূল্য পড়ছে ৬৫ টাকা ৭০ পয়সা। ভ্যাট-ট্যাক্স ও অন্যান্য চার্জ যোগ করলে তা দাঁড়ায় ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা।
এদিকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির শুনানিতে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম বলেন, আবেদনের পর্যায়ে থাকা দাবি-দাওয়া আন্দোলনেরপর্যায়ে গেলে তা হবে আরেকটা জাতীয় দুর্ভাগ্য। রাজধানীর বিয়াম মিলনায়তনে গতকাল সকাল ১০টায় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভ গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর শুনানি গ্রহণ করে। শিল্পকারখানার বয়লার ও জেনারেটরে সরবরাহ করা গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১.৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
শুনানিতে উপস্থিত জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এম শামসুল আলম এ প্রস্তাবকে ‘গণবিরোধী’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত এসব দাবি জনগণের পক্ষ থেকে আবেদনেরপর্যায়ে আছে। সরকার ও বিইআরসি-কে অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে এটি আন্দোলনের পর্যায়ে না যায়। যদি তা হয়, তাহলে এটি হবে জাতীয় দুর্ভাগ্য।’
তিনি বলেন, ‘আমরা বিআরসি-কে তিন দিন সময় দিয়ে জানাব। এই তিন দিনের মধ্যে বিআরসি সবকিছুই করবে। আগামী রোববার বিআরসি সরকারকে এ বিষয়ে জানাবে। বিআরসির আইনের আওতায় সরকারকে পরামর্শ দেয়ার ইতিহাস রয়েছে। বিআরসি সেটি পরামর্শ দেবে এবং পাশাপাশি এই কাজগুলো বিআরসি করতে পারে সরকারের সঙ্গে আনঅফিশিয়ালি।’
শুনানিতে এম শামসুল আলম বলেন, ‘৩৪০০ কোটি টাকা বাড়ানোর জন্য শিল্পের ৩০ টাকা থেকে ৭৫ টাকা করার যে প্রস্তাব, তা ভয়ঙ্কর রকম গণবিরোধী। শুধুমাত্র সরকারের কাছ থেকে এই অর্থ নেয়ার চেষ্টা চলছে, যা জনগণের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।