Amar Sangbad
ঢাকা বুধবার, ২৬ মার্চ, ২০২৫,

জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস

ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন

নিজস্ব প্রতিবেদক

নিজস্ব প্রতিবেদক

মার্চ ২৬, ২০২৫, ১২:২২ এএম


ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন
  • শেখ হাসিনার নিষ্ঠুরতা পৃথিবীর সব কিছু ছাড়িয়ে গেছে

  • স্বাধীনতা পুরস্কার তুলে দিলেন প্রধান উপদেষ্টা

চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হবে। এজন্য নির্বাচন কমিশন সব ধরনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। মহান স্বাধীনতা দিবস ও পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে গতকাল মঙ্গলবার রাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি এসব কথা বলেন।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের কাজ শুরু করেছে। ছয়টি সংস্কার কমিশনের ১৬৬টি সুপারিশ ও পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনসহ ৩৮টি রাজনৈতিক দলের কাছে চিঠি দেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক শুরু হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক দলগুলো খুবই ইতিবাচকভাবে সংস্কার কাজে সাড়া দিয়ে তাদের মতামত তুলে ধরেছেন। কোন রাজনৈতিক দল কোন কোন সংস্কার প্রস্তাবে একমত হয়েছে, কোনটিতে দ্বিমত হয়েছে- সেসব তারা জানাচ্ছেন। এটা আমাদের জাতির জন্য অত্যন্ত সুখবর, প্রতিটি রাজনৈতিক দল সংস্কারের পক্ষে মত দিচ্ছে। ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে সব রাজনৈতিক দলের মতামত নেয়ার কাজ এখন চলমান আছে। কমিশনের লক্ষ্য হচ্ছে যে সব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হবে সেগুলো চিহ্নিত করা এবং তার একটা তালিকা প্রস্তুত করা। যেসব দল এতে একমত হয়েছে তাদের স্বাক্ষর নেয়া। এই তালিকাটিই হবে জুলাই চার্টার বা জুলাই সনদ।’

তিনি বলেন, আমাদের দায়িত্ব, জাতির সামনে পুরো প্রক্রিয়াটা স্বচ্ছভাবে তুলে ধরা এবং প্রক্রিয়া শেষে নির্বাচনের আয়োজন করা। নির্বাচনের ব্যাপারে আমি আগেও বলেছি, আবারও বলছি, এ বছর ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য পৃথিবীর সব নিষ্ঠুরতা ছাড়িয়ে গেছেন। জাতিসংঘের রিপোর্ট পড়ে সবার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেছে। কী ভয়াবহতা! কীভাবে একজন প্রধানমন্ত্রী নিজ দেশের নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার পর লাশ লুকিয়ে ফেলার নির্দেশ দিতে পারে! ক্ষমতা আঁকড়ে রাখার জন্য তিনি পৃথিবীর সব নিষ্ঠুরতা ছাড়িয়ে গেছেন- এটাই জাতিসংঘের প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস কয়েকদিন আগে বাংলাদেশ সফর করেছেন। তাকে সঙ্গে নিয়ে আমি কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে গিয়েছি। ক্যাম্পে অবস্থানরত ১ লাখ রোহিঙ্গা শিশু-কিশোর, নারী-পুরুষ সবার সঙ্গে একসঙ্গে ইফতার করেছি। আমাদের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে আগামী সেপ্টেম্বর মাসে জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে একটি পৃথক অধিবেশন আয়োজন করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মালয়েশিয়া ও ফিনল্যান্ড যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজক হতে এগিয়ে এসেছে। এর পাশাপাশি, অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী জুলি বিশপকে এই গুরুত্বপূর্ণ সভায় মুখ্য ভূমিকা পালনের জন্য আমি আহ্বান জানিয়েছি। তিনি আমার প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, পতিত স্বৈরাচারের নিপীড়নের বর্ণনা উঠে এসেছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের রিপোর্টে। গত জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ওপর শেখ হাসিনা সরকার ও আওয়ামী লীগ যে দমন-নিপীড়ন ও হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে এর পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করে বিস্তারিত রিপোর্ট প্রকাশ করেছে তারা।

‘রিপোর্টে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে যে, শেখ হাসিনা নিজেই নিরাপত্তা বাহিনীর কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন বিক্ষোভকারীদের হত্যা করতে। বিগত সরকার, আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগের সহযোগী গোষ্ঠী ও সংগঠন একত্রিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে জড়িত ছিল। মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বিক্ষোভ চলাকালে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে প্রায় ১৩ শতাংশ শিশু। বিক্ষোভের সন্মুখসারিতে থাকার কারণে, আমাদের জুলাই-কন্যারা নিরাপত্তা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে, এমনকি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার কার্যালয়ের এই রিপোর্টকে আমরা স্বাগত জানাচ্ছি। প্রতিবেদনে যে সুপারিশ করা হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার সে সুপারিশগুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। আপনাদের আশ্বস্ত করে বলতে চাই, যারা গণহত্যায় জড়িত ছিল, যারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করেছে, যারা ইতোমধ্যে হত্যাকারী হিসেবে বিশ্বের কাছে স্বীকৃত তাদের বিচার এদেশের মাটিতেই হবে।

স্বাধীনতা পুরস্কার তুলে দিলেন প্রধান উপদেষ্টা

স্বাধীন বাংলাদেশে এখনো ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা যায়নি উল্লেখ করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দীর্ঘদিন ধরে এদেশের মানুষকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। দুর্নীতি, লুটপাটতন্ত্র ও গুম-খুনের রাজত্ব চালিয়ে দেশে একটি ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা কায়েম করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, যেখানে আইনের শাসন থাকবে, মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত হবে এবং একটি বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে। কিন্তু ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এখনো প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। প্রধান উপদেষ্টা গতকাল মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২৫’ প্রদান অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন।

জাতীয় পর্যায়ে নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ সাত বিশিষ্ট ব্যক্তিকে এবার ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২৫’ এ ভূষিত করা হয়। এর মধ্যে ছয়জন মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার পেয়েছেন এবং জীবিতদের মধ্যে রয়েছেন লেখক ও বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর।

প্রধান উপদেষ্টা মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তদের পরিবারের সদস্যদের হাতে পদক তুলে দেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সব বীর শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আজ (গতকাল মঙ্গলবার) ২৫ মার্চ। মানব সভ্যতার ইতিহাসে কলঙ্কিত এক হত্যাযজ্ঞের দিন। ১৯৭১ সালের আজকের রাতে পাক হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র, ঘুমন্ত বাঙালির ওপর নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হাজারো মানুষকে হত্যা করে। ২৫ মার্চ থেকেই এ দেশের মানুষ সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। ৯ মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, তাদের আত্মত্যাগের কারণে আমরা একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছি। এ সুযোগ আমরা কোনোক্রমেই বৃথা যেতে দেব না।

জীবিত থাকা অবস্থায় স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদানের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যারা আজ এ সম্মাননা পেলেন তারা জীবদ্দশায় এ প্রাপ্তি দেখে যেতে পারেননি। এটা অত্যন্ত বেদনাদায়ক। আজকের দিনে তাদের অবদানকে আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি।

জীবিত থাকতে পুরস্কার পেলে সেটা নিজের এবং পরিবারের জন্য আরও আনন্দের হতো উল্লেখ করে তিনি বলেন, যাকে আমরা সম্মান দেখাচ্ছি তিনি আমাদের মধ্যে নেই। আমরা যেন আগামীতে এমন একটা নিয়ম করতে পারি যাদের মরণোত্তর দেয়ার, তাদের পালা শেষ করে যারা জীবিত আছেন, প্রতিবছর তাদের অর্ধেককে যেন পুরস্কার দেয়া যায়।

স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তরা দেশ ও জাতিকে অনেক কিছু দিয়ে গেছেন উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস আরও বলেন, যাদেরকে পুরস্কার দেয়া হচ্ছে আমরা কেবল তাদেরকে সম্মানিত করছি না, জাতি হিসেবে আমরাও সম্মানিত হচ্ছি। তারা এই জাতির জন্য অনেক কিছু দিয়ে গেছেন। তাদের কথা তাদের জীবদ্দশায় স্মরণ করতে না পারলে আমরা অকৃতজ্ঞ জাতি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকব। যাদেরকে আমরা এই সম্মান দিতে চাই- সেটা যথাসময়ে যেন আমরা দিতে পারি। স্বাধীনতা পুরস্কার পাওয়া বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের অবদানের কথা স্মরণ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, যে জেন-জি প্রজন্ম, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন তাদের অনুপ্রেরণার নাম বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। সে ন্যায়বিচারের জন্য, বাকস্বাধীনতার জন্য জোরালো প্রতিবাদ করে সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হয়েছিল। তাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানাতে পেরে আমরা গর্বিত। এবার স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত একমাত্র জীবিত ব্যক্তি লেখক ও বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমরের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বদরুদ্দীন উমরকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা জানাতে পেরে আমরা আনন্দিত। তার সম্মাননা স্মারক আমাদের পরের প্রজন্মের জন্য অনুপ্রেরণা হিসেবে জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকবে। ‘স্বাধীনতা পুরস্কার-২০২৫’-এ ভূষিত ব্যক্তিদের বাংলার সূর্যসন্তান বলে অভিহিত করেন তিনি। মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারের পদক গ্রহণের পর আবরার ফাহাদের মা মোছা. রোকেয়া খাতুনসহ অন্যরা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন।

এবার স্বাধীনতা পুরস্কার প্রাপ্তরা হলেন- বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম (মরণোত্তর), সাহিত্যে মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ (মরণোত্তর), সংস্কৃতিতে নভেরা আহমেদ (মরণোত্তর), সমাজসেবায় স্যার ফজলে হাসান আবেদ (মরণোত্তর), মুক্তিযুদ্ধ ও সংস্কৃতিতে মোহাম্মদ মাহবুবুল হক খান ওরফে আজম খান (মরণোত্তর), শিক্ষা ও গবেষণায় বদরুদ্দীন মোহাম্মদ উমর এবং প্রতিবাদী তারুণ্যে আবরার ফাহাদ (মরণোত্তর)। মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ মো. আব্দুর রশীদ পুরস্কার বিতরণী পর্বটি সঞ্চালনা করেন। তিনি পুরস্কার বিজয়ীদের সাইটেশন পাঠ করেন।

অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা, প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত ও বিশেষ সহকারী এবং সরকারের জ্যেষ্ঠ কমকর্তা ও রাজনৈতিকদলের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।

Link copied!