নিজস্ব প্রতিবেদক
এপ্রিল ৬, ২০২৫, ১১:০৮ এএম
নিজস্ব প্রতিবেদক
এপ্রিল ৬, ২০২৫, ১১:০৮ এএম
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের নতুন শুল্ক ঘোষণার ফলে বিশ্ববাণিজ্যে বড় ধরনের ধস নেমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন এই শুল্কনীতির জেরে ২০২৫ সালে বিশ্ববাণিজ্য প্রায় ১ শতাংশ কমতে পারে বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)। পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপে বাণিজ্যযুদ্ধের সম্ভাবনা বাড়ছে। এরই মধ্যে শেয়ারবাজার, মুদ্রাবাজার ও স্বর্ণবাজারে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বিশ্বের বিভিন্ন নেতা ট্রাম্পের এই পদক্ষেপকে বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশ করা সব আমদানি পণ্যের ওপর ১০ শতাংশ হারে বেসলাইন ট্যারিফ বা সাধারণ শুল্ক এবং বাংলাদেশসহ অর্ধশতাধিক দেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে উচ্চ শুল্কহার আরোপ করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
গতকাল শনিবার থেকে মার্কিন বন্দরগুলোতে আসা সব আমদানি পণ্যের ওপর থেকে ১০ শতাংশ হারে সাধারণ শুল্ক কেটে নেয়া শুরু করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। এ প্রেক্ষাপটে গতকাল শনিবার রাতে জরুরি বৈঠকে বসেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ ইউনূস। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অনুষ্ঠিত ওই বৈঠক শেষে সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন জানিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আরোপ করা শুল্ক ইস্যুতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নিজেই দেশটির প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করবেন।
বাণিজ্য উপদেষ্টা জানান, আমদানি বৃদ্ধির মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঘাটতি কমানোর প্রচেষ্টা করা হবে। শুল্ক বাড়ানো আকস্মিক বিষয় নয়। এতে বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা কম। প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে (শুল্ক আরোপের বিষয়) সমাধান হবে। গত ২ এপ্রিল ওয়াশিংটনের স্থানীয় সময় বিকাল ৪টায় হোয়াইট হাউসে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে ৩৭ শতাংশ করার ঘোষণা দেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
এর আগে বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক ছিল গড়ে ১৫ শতাংশ। হোয়াইট হাউস প্রকাশিত তালিকায় দাবি করা হয়, বাংলাদেশ মার্কিন পণ্যের ওপর ৭৪ শতাংশ শুল্ক ধার্য করে। এর বিপরীতে বাংলাদেশি পণ্যের ওপর ৩৭ শতাংশ ‘পাল্টা শুল্ক’ ধার্য করে ট্রাম্প প্রশাসন। ওই তালিকা অনুযায়ী, পাকিস্তানের ওপর ২৯ শতাংশ, ভারতের ওপর ২৬ শতাংশ, চীনের ওপর ৩৪ শতাংশ, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর ওপর ২০ শতাংশ, কম্বোডিয়ার পণ্যে ৪৯ শতাংশ, ভিয়েতনামে ৪৬ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৪৪ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ৩৬ শতাংশ, তাইওয়ানে ৩২ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ৩২ শতাংশ, সুইজারল্যান্ডে ৩১ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩০ শতাংশ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ২৫ শতাংশ, জাপানে ২৪ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ২৪ শতাংশ, ইসরাইলে ১৭ শতাংশ, ফিলিপাইনে ১৭ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ১০ শতাংশ, যুক্তরাজ্যে ১০ শতাংশ, তুরস্ক, ব্রাজিল, চিলি এবং অস্ট্রেলিয়ায় ১০ শতাংশ করে শুল্ক আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্বজনস্বীকৃত শুল্ক হারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রায় ১০০ বছরের রেকর্ড ভেঙে গত বুধবার হোয়াইট হাউস থেকে সর্বোচ্চ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দেয়া হয়। ট্রাম্পের আগের মেয়াদে হোয়াইট হাউসের বাণিজ্য উপদেষ্টা কেলি অ্যান শ বলছেন, তার জীবদ্দশায় এত বড় আর বিস্তৃত একক বাণিজ্য পদক্ষেপ দেখেননি। বিশ্বের প্রতিটি দেশের সঙ্গে মার্কিন বাণিজ্য সম্পর্কে বিরাট ও তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন এটি।
যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী শুল্কনীতির কারণে চলতি বছর বৈশ্বিক পণ্য বাণিজ্যের পরিমাণ প্রায় ১ শতাংশ কমবে বলে এরই মধ্যে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মহাপরিচালক এনগোজি ওকনজো-ইওয়ালা। এর ফলে পাল্টাপাল্টি শুল্ক আরোপের ফলে বিশ্ব ব্যবস্থা একটি শুল্ক যুদ্ধের চক্রে ঘুরপাক খাবে বলে গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে তিনি সতর্ক করেন। শুল্ক যুদ্ধ শুরুর আলামত মিলেছে এরই মধ্যে। গত বুধবার যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীনের পণ্যের ওপর ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন ট্রাম্প। জবাবে গত শুক্রবার চীনও মার্কিন পণ্যের ওপর পাল্টা ৩৪ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। চীনের পাল্টা আঘাত বিশ্ববাণিজ্যের গতিপথ পাল্টে দিতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কারণ, মার্কিন কৃষিপণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার চীন। গত দুই বছরে আমদানি কমে ৪২.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২৯.২৫ বিলিয়ন ডলারে নামলেও তা সর্বোচ্চ। কিন্তু আগ্রাসী শুল্কের মুখে পড়ে কৃষিপণ্যের বিকল্প উৎস খুঁজছে বেইজিং। ফলে ট্রাম্পের শুরু করা বাণিজ্যযুদ্ধের সবচেয়ে বড় আঘাত যে মার্কিন কৃষির ওপর পড়বে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ‘রিসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ’ নামে ট্রাম্পের আগ্রাসী শুল্কনীতি বিশ্ববাজারে বড় ধাক্কা দিয়েছে। এর ফলে বড় বড় প্রায় সব শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে; তেল-সোনাসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ব্যাপক দরপতন হয়েছে। বিশ্ববাণিজ্যে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে।
চীনের পাল্টা শুল্ক ঘোষণার পর গত শুক্রবার টানা দ্বিতীয় দিনের মতো ওয়াল স্ট্রিটে ব্যাপক দরপতন হয়েছে। মাত্র দুই দিনে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের কোম্পানিগুলো ৫ ট্রিলিয়ন ডলার বা ৫ লাখ কোটি ডলার বাজার মূলধন হারিয়েছে। দুই দিনে ১০ শতাংশের বেশি কমেছে এসঅ্যান্ডপি-৫০০ সূচক। এসঅ্যান্ডপি-৫০০ ছাড়া মার্কিন শেয়ারবাজারের আরও দুই সূচক ডাউ জোন্স ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ ও নাসডাক কম্পোজিটেও বড় দরপতন হয়েছে, ২০২০ সালের পর সর্বোচ্চ। দুই দিনে ডাউ সূচক ৯ দশমিক ৩ শতাংশ ও নাসডাক সূচক ১১ দশমিক ৪ শতাংশ কমেছে।
গতকাল উদ্বেগের ঢেউ থেকে কোনো বাজারই রেহাই পায়নি। মুদ্রাবাজারের মধ্যে এক মাস ধরে চলা ইউরোর অস্থিরতা বেড়ে দুই বছরের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। ডলারের বিপরীতে ইউরোপের সাধারণ মুদ্রাটির দর প্রায় ১ শতাংশ কমে যায়।
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কনীতি ডলারকে বড় ধরনের ধাক্কা দিয়েছে। শক্তিশালী ডলারের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে গিয়ে আমদানি পণ্যের ওপর শুল্ক আরোপের ফলে আমেরিকানদের ব্যয় বাড়িয়ে তুলছে। বাড়তি শুল্কের অর্থনৈতিক প্রভাব নিয়ে বিনিয়োগকারীরা সতর্ক থাকায় একগুচ্ছ মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দরের সূচক ৪.৭ শতাংশ কমে ছয় মাসের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নামে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শুল্কের কারণে বাজারে সোনা বিক্রির হিড়িক পড়ে। এর ফলে গত বৃহস্পতিবার ২ শতাংশের বেশি দরপতন হয় সোনার। যদিও এর সর্বকালের উচ্চতম স্তরে পৌঁছে সোনার দাম। এর আগে স্পট গোল্ড বা তাৎক্ষণিক লেনদেনে সোনার দাম ৩১৬৭.৫৭ ডলারে ওঠে। পরে তা ০.৮৫ শতাংশ কমে ৩ হাজার ১০৬.৯৯ ডলারে নামে। যুক্তরাষ্ট্রের গোল্ড ফিউচার্স বা আগাম লেনদেনের সোনার দর ১ দশমিক ৪ শতাংশ কমে ৩১২১.৭০ ডলারে নামে।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, এই পতনের পেছনে মুনাফা তুলে নেয়ার ঝোঁকের পাশাপাশি অন্যান্য সম্পদশ্রেণিতে মার্জিন কলের প্রভাব অর্থাৎ ব্রোকার অ্যাকাউন্টে নগদ জমার জমার বাধ্যবাধকতার ভূমিকা আছে। ফলে বিনিয়োগকারীরা কিছু সোনা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন। এক বিবৃতিতে ডব্লিউটিও মহাপরিচালক সতর্ক করে বলেন, বিশ্ববাণিজ্য ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার ওপর নতুন মার্কিন শুল্কের মারাত্মক প্রভাব পড়বে। প্রাথমিক মূল্যায়নে চলতি বছরের শুরু থেকে চালু শুল্কের সঙ্গে মিলে নতুন শুল্কের কারণে বৈশ্বিক পণ্যবাণিজ্য প্রায় ১ শতাংশ কমতে পারে। বিশ্ব বাণিজ্যের বিশাল অংশ ডব্লিউটিওর ‘মোস্ট ফেবারড ন্যাশন (এমএফএন)’ শর্তের অধীনে পরিচালিত হচ্ছে।
বর্তমান হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ৭৪% বাণিজ্য এখন এই শর্ত মেনে হয়, যা বছরের শুরুতে ছিল প্রায় ৮০ শতাংশ। ট্রাম্পের শুল্কনীতির কারণে এই হার কমে গেছে। ডব্লিউটিওর সব সদস্যকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, এত বড় পরিসরের বাণিজ্যিক পদক্ষেপ বড় উত্তেজনা তৈরি করবে। কিন্তু সেই চাপ দায়িত্বশীলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। বাণিজ্য বিরোধ ঠেকিয়ে উন্মুক্ত ও পূর্বাভাসযোগ্য বাণিজ্য পরিবেশের জন্য সংলাপের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ডব্লিউটিও গঠিত হয়। গঠনমূলক আলোচনার জন্য এই ফোরামকে ব্যবহার করে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে।